গাজায় শিক্ষা: গণহত্যার আগুনে ঝলসে যাওয়া শিশুদের স্বপ্ন!

গাজায় শিক্ষাব্যবস্থা: গণহত্যার শিকার, ভবিষ্যৎ অন্ধকারে

যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের ফলে সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। এক সময়ের শিক্ষার আলো ঝলমলে গাজা এখন যেন এক গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত।

ইসরায়েলি বোমা হামলায় গুঁড়িয়ে গেছে স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী।

গাজার শিক্ষাব্যবস্থা একসময় ছিল বেশ উন্নত। অবরোধ আর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, এখানকার সাক্ষরতার হার ছিল ৯৭ শতাংশ।

মাধ্যমিক স্তরে ৯০ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষায় ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী তালিকাভুক্ত ছিল। এখানকার সরকার ও ইউএনআরডব্লিউ-র (UNRWA) তত্ত্বাবধানে পরিচালিত স্কুলগুলোতে বিনামূল্যে পাঠদানের ব্যবস্থা ছিল।

দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরাও যাতে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়, সেজন্য বিনামূল্যে বই ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হতো। মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল বিভিন্ন বৃত্তি ও বিশেষ সুযোগের ব্যবস্থা।

খেলাধুলা এবং প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার প্রসারেও নেওয়া হয়েছিল নানা উদ্যোগ।

কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে গাজায় শুরু হওয়া গণহত্যায় সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায়। ইসরায়েলি বাহিনী শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং তারা শিক্ষার অধিকারকেই কেড়ে নিয়েছে।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ৫৬৪টি স্কুলের মধ্যে প্রায় ৮৮ শতাংশ, অর্থাৎ ৪৯৬টি স্কুল হয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, নয়তো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজার সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজও এখন ধ্বংসস্তূপ।

৬ লাখ ৪৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী আজ ক্লাসরুম থেকে বঞ্চিত। উচ্চশিক্ষার সুযোগ হারানো শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯০ হাজার।

যুদ্ধ পরিস্থিতি চলতে থাকায় কর্তৃপক্ষ স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পুনরায় চালু করার চেষ্টা করেছিল। স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য সরাসরি ক্লাস এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইনে ক্লাস শুরু করা হয়।

উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে স্বেচ্ছাসেবকরা বিনামূল্যে শিশুদের পড়ানো শুরু করেন। তবে, নিয়মিত শিক্ষার অভাবে একটা বড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে।

বোমাবর্ষণ ও বাস্তুচ্যুত হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে উপস্থিত হওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। অর্থের অভাবে উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে ভালো মানের শিক্ষাদানও সম্ভব হচ্ছে না।

এই পরিস্থিতিতে কিছু প্রাইভেট শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে পড়ানো হয়। সেখানে প্রতি বিষয়ে মাসে ২৫ থেকে ৩০ মার্কিন ডলার (প্রায় ২,৭০০ থেকে ৩,৩০০ টাকা) খরচ হয়।

আটটি বিষয়ের জন্য মাসে প্রায় ২৪০ ডলার (প্রায় ২৬,০০০ টাকা) লাগে, যা গাজার অধিকাংশ পরিবারের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।

অনলাইন ক্লাস করার জন্য কম্পিউটার, ইন্টারনেট ও বিদ্যুতের প্রয়োজন। বোমা হামলায় যারা তাদের ডিভাইস হারিয়েছে, তারা এখন নতুন করে ডিভাইস কিনতে পারছে না।

ইন্টারনেট ও বিদ্যুতের জন্য ঘন্টায় ৫ ডলার পর্যন্ত খরচ করতে হচ্ছে। ফলে অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।

গাজায় শিক্ষার এই করুণ পরিস্থিতি সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। একদিকে যেমন বাড়ছে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য, তেমনিভাবে শিক্ষার অভাবে একটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে।

দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা এখন বিদ্যালয়ে যাওয়ার পরিবর্তে জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। শিশুদের এই অসহায়ত্ব দেখে অনেকেই ব্যথিত হচ্ছেন।

এক বছর আগেও যারা স্কুলে যাওয়ার জন্য হাসিখুশি মনে দৌঁড়াতো, আজ তাদেরকেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করতে অথবা জিনিসপত্র বিক্রি করতে দেখা যায়।

গাজার মানুষের কাছে শিক্ষা শুধু একটি সনদ বা ডিগ্রি অর্জনের বিষয় ছিল না। এটি ছিল তাদের আশা, সাহস এবং ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একটি উপায়।

শিক্ষা ছিল দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাওয়ার এবং জীবনমান উন্নয়নের একটি সুযোগ। কিন্তু বর্তমানে সেই আশা, সেই স্বপ্ন ইসরায়েলি বোমার আঘাতে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।

গাজায় যা ঘটছে, তা নিছক একটি সাময়িক সংকট নয়, বরং এটি একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, গাজাবাসীকে তাদের ভূমি থেকে বিতাড়িত করা।

তবে, ফিলিস্তিনিরা এখনো তাদের ভূমি ছাড়তে রাজি নয়। তারা তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি শিশুরা, যারা সবচেয়ে অসহায়, তারাও হাল ছাড়েনি।

আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গাজার জনগণের পাশে দাঁড়াবে এবং তাদের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *