ওয়াকো অবরোধ: বিভীষিকাময় দিনের সাক্ষী, বিতর্কের অবসান হয়নি আজও।
আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগের এক বিভীষিকাময় দিনের সাক্ষী ছিল টেক্সাসের ওয়াকো শহর। ১৯৯৩ সালের সেই ১৯শে এপ্রিল, আমেরিকার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের জন্ম হয়, যা ওয়াকো অবরোধ নামে পরিচিত। এই ঘটনায় প্রায় ৮০ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়, যাদের মধ্যে ছিলেন ধর্মীয় গোষ্ঠী ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান-এর সদস্যরা এবং তাদের নেতা ডেভিড কোরেস। ঘটনার এত বছর পরেও, সেই দিনের স্মৃতি আজও বিতর্কিত, আর এই ঘটনার দায় কার, তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি।
ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান-দের উত্থান:
১৯৫০-এর দশকে প্রতিষ্ঠিত ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান ছিল একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী। তারা যিশু খ্রিস্টের দ্বিতীয় আগমনের প্রত্যাশা করত এবং নিজেদের একটি “শুদ্ধ গির্জা” হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল। তারা ওয়াকোর বাইরে একটি স্বনির্ভর কমিউনিটি তৈরি করেছিল, যেখানে বাইরের জগতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল সীমিত।
১৯৮০-র দশকে গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে ডেভিড কোরেস, যিনি মূলত ভার্নন হাওয়েল নামে পরিচিত ছিলেন, বন্দুকের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। কোরেস বাইবেলের একজন শিক্ষক ছিলেন, যিনি নিজেকে ঈশ্বরের দূত হিসেবে দাবি করতেন এবং অনুসারীদের মধ্যে এক বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অবরোধের সূচনা:
১৯৯২ সাল থেকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালকোহল, তামাক, আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যুরো (এ টি এফ) ডেভিড কোরেস এবং ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান-দের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অস্ত্র তৈরির অভিযোগের তদন্ত শুরু করে। তদন্তকারীরা জানতে পারেন, গোষ্ঠীটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, বোমা ও গ্রেনেড তৈরি করছে।
এর ফলস্বরূপ, ১৯৯৩ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি, এ টি এফ সদস্যরা ওয়াকোর কাছে মাউন্ট কারমেল কম্পাউন্ডে অভিযান চালায়। কিন্তু সেখানে উভয়পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি শুরু হয়। এতে এ টি এফ-এর চারজন এবং ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান-এর ছয়জন সদস্য নিহত হন। কোরেসও আহত হন। এর পরেই শুরু হয় ৫১ দিনের এক দীর্ঘ অচলাবস্থা, যা ওয়াকো অবরোধ নামে পরিচিত।
অবরোধের সময়:
অবরোধের সময়, এফবিআই সদস্যরা ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান-দের কম্পাউন্ড থেকে বের করে আনার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে। তারা রাতের বেলা উচ্চ শব্দে গান বাজানো থেকে শুরু করে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার চেষ্টা করে। এফবিআইয়ের ৫০ জনের বেশি সদস্য কোরেসের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা করেন। কিন্তু কোরেস কোনো নতি স্বীকার করেননি।
আগুনের বিভীষিকা:
১৯শে এপ্রিল, ১৯৯৩। আলোচনার ব্যর্থতার পর, এ টি এফ সদস্যরা কম্পাউন্ডে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। এর কিছুক্ষণ পরেই, কম্পাউন্ডে আগুন লাগে। সেই আগুনে পুড়ে মারা যায় ৭৬ জন ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান সদস্য, যাদের মধ্যে ২০ জনের বেশি শিশু ছিল। ডেভিড কোরেসও সেই আগুনে নিহত হন।
দায়িত্ব কার?:
ওয়াকো অবরোধের মূল বিতর্ক হলো, এই অগ্নিকাণ্ডের জন্য কে দায়ী? এফবিআই দাবি করে, ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান-রাই ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন ধরিয়েছিল। তাদের মতে, কম্পাউন্ডের ভেতরে থাকা সদস্যরা নাকি কোরেসের নির্দেশে আগুন লাগিয়েছিল। কিন্তু, অনেক ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান সদস্য এবং তাদের সমর্থকরা আজও ফেডারেল এজেন্টদের দিকে আঙুল তোলেন। তাদের অভিযোগ, সরকারি এজেন্টদের ছোড়া টিয়ার গ্যাসের কারণে কেরোসিন ল্যাম্প উল্টে আগুন লেগেছিল।
পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ:
ওয়াকো অবরোধের পর, ঘটনার তদন্ত হয়। কিছু ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান সদস্যকে ফেব্রুয়ারির বন্দুকযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তবে, অগ্নিকাণ্ডের জন্য সরাসরি কাউকে দায়ী করা যায়নি। এই ঘটনার পর, মার্কিন বিচার বিভাগ এবং ট্রেজারি বিভাগ এ টি এফ-এর কিছু কৌশলকে সমালোচনা করে। কিন্তু, তারা শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে আসে যে, এ টি এফ সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালনে নিবেদিত ছিলেন।
ওয়াকো অবরোধের ঘটনা আজও আমেরিকান সমাজে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে রেখেছে। এটি একদিকে যেমন ধর্মীয় গোঁড়ামি ও চরমপন্থার বিপদকে তুলে ধরে, তেমনি সরকারের ক্ষমতা প্রয়োগ এবং জনসাধারণের নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তাকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।
তথ্যসূত্র: আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা।