দক্ষিণ আফ্রিকার ‘সোনার শহর’ জোহানেসবার্গ: দারিদ্র্য আর উন্নয়নের দ্বন্দ্বে এক বিপর্যস্ত জনপদ।
দক্ষিণ আফ্রিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর জোহানেসবার্গ। একসময় একে ‘সোনার শহর’ হিসেবেও অভিহিত করা হতো।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই শহরের অনেক কিছুই যেন বদলে গেছে। একদিকে যেমন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে, গড়ে উঠেছে নতুন নতুন বাণিজ্যিক এলাকা, তেমনিভাবে দারিদ্র্য, অনাহার আর নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অভাব যেন এই শহরের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান নিয়ে সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
জোহানেসবার্গের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি এলাকা, যেখানে পুরোনো বাড়িগুলোতে বসবাস করা মানুষের জীবনযাত্রা খুবই কষ্টের। অনেক বাড়িতেই নেই বিদ্যুৎ বা জলের ব্যবস্থা।
বাড়িগুলোর ছাদ ক্ষতিগ্রস্ত, যা সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য এক চরম দুর্ভোগের কারণ। শহরের এই অংশে অপরাধের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে।
শহরের বাইরেও অনেক এলাকার অবস্থা ভালো নয়। সেখানকার বাসিন্দারা পানি এবং রাস্তাঘাটের মতো মৌলিক সুবিধাগুলো থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একটি জরিপে এখানকার জীবনযাত্রার মানের অবনতি হয়েছে বলে জানা গেছে। এমনকি, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা শহরের পরিবেশকে ‘অসন্তোষজনক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং শহরটিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করেছেন।
নভেম্বরে এখানে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
তবে, এই সংকটকালে শহরের শিল্পী এবং ব্যবসায়ীরা শহরটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য এগিয়ে এসেছেন। ‘জোজি মাই জোজি’ নামের একটি ব্যবসায়ী জোট শহরটিকে নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করছে।
তারা ইতোমধ্যে ৬০০-র বেশি সৌর-বিদ্যুৎ চালিত রাস্তার বাতি স্থাপন করেছে এবং স্থানীয় কমিউনিটির সঙ্গে কাজ করছে।
তাদের এই কার্যক্রম শহরটির পুরনো এলাকাগুলোতেও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
অন্যদিকে, শহরের কিছু এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্পের নামে স্থানীয় বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করার অভিযোগ উঠেছে। মানবাধিকার সংস্থা ‘সোসিও-ইকোনমিক রাইটস ইনস্টিটিউট অফ সাউথ আফ্রিকা’র (সেরি) মতে, এমন উন্নয়ন প্রকল্পগুলো প্রায়ই বাসিন্দাদের বিতাড়িত করে এবং এরপর ভাড়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
তাদের প্রশ্ন, শহরের কেন্দ্রে দরিদ্র মানুষের কি কোনো স্থান নেই?
জোহানেসবার্গ একটি চরম বৈষম্যপূর্ণ শহর। এখানে যেমন ‘আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী এলাকা’ খ্যাত স্যান্ডটন রয়েছে, তেমনি রয়েছে দরিদ্র মানুষের আবাসস্থল, যেখানে মৌলিক চাহিদাও অপূর্ণ।
শহরটি যখন প্রথম গড়ে উঠেছিল, তখন এখানে প্রায় এক মিলিয়ন গাছ লাগানো হয়েছিল।
কিন্তু এখানকার শহরতলির অবস্থা বেশ করুণ।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, জোহানেসবার্গে বর্ণবাদের বিভাজন ছিল স্পষ্ট। শ্রমিক শ্রেণির মানুষজন খনি অঞ্চলের কাছাকাছি বসবাস করত, আর শ্বেতাঙ্গরা থাকত উঁচু এলাকার বাগানবাড়িতে।
শহরের এই সামাজিক বিভাজন আজও বিদ্যমান।
শহরের সমস্যাগুলো দরিদ্রদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে।
গত কয়েক বছরে মেয়র পরিবর্তনের কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে।
এমনকি, শহরের একটি পুরনো ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৭৭ জন নিহত হওয়ার পর কর্তৃপক্ষের অবহেলা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
শহর কর্তৃপক্ষ বর্তমানে ‘খারাপ ভবন’ চিহ্নিত করার জন্য একটি বিশেষ কার্যক্রম শুরু করেছে।
তারা কিছু ভবন থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য আদালতের নির্দেশও পেয়েছে।
মানহাটান কোর্ট-এর মতো কিছু ভবনে বাসিন্দারা নিজেরাই নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য চেষ্টা করছেন।
তারা শহরের পরিষেবার জন্য প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করেন এবং তাদের বাসস্থান রক্ষার চেষ্টা করছেন।
তবে, শহরের এই কঠিন পরিস্থিতিতেও কিছু মানুষ তাদের আশা বাঁচিয়ে রেখেছেন। ‘ব্যাগ ফ্যাক্টরি’র মতো কিছু শিল্পী স্টুডিও দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিল্পীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করছে।
সেখানকার শিল্পীরা তাদের কাজের মাধ্যমে শহরের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।
তাদের মতে, জোহানেসবার্গ সব সময়ই একটি প্রাণবন্ত শহর ছিল এবং তারা সেই প্রাণশক্তির অংশ হতে পেরে গর্বিত।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান