যুদ্ধবিরতি: পুতিনের ‘প্রতারণা’ ফাঁস! কড়া জবাব জেলেনস্কির

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘোষিত ইস্টার যুদ্ধবিরতিকে ‘লোক দেখানো’ আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। জেলেনস্কির অভিযোগ, রাশিয়া ঘোষিত যুদ্ধবিরতির সময়ও ইউক্রেন জুড়ে ড্রোন হামলা ও আর্টিলারি শেলিং অব্যাহত রেখেছে।

রবিবার এক বিবৃতিতে জেলেনস্কি বলেন, ইউক্রেনের সামরিক কমান্ডার-ইন-চিফ ওলেক্সান্ডার সিরস্কি’র রিপোর্ট অনুযায়ী, রাশিয়া এখনো ভারী অস্ত্র ব্যবহার করছে। তিনি আরও জানান, রবিবার সকাল ১০টা থেকে রাশিয়ার গোলাবর্ষণ বেড়ে গেছে। এমনকি তারা কামikaze ড্রোন ব্যবহারের পরিমাণও দ্বিগুণ করেছে। শনিবার মধ্যরাত থেকে রবিবার দুপুর পর্যন্ত ২৬টি হামলা চালানো হয়েছে।

পুতিন শুক্রবার এই ৩০ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিলেন, যা সোমবার মধ্যরাতে শেষ হওয়ার কথা।

জেলেনস্কি বলেন, “আমরা ইস্টার উপলক্ষে রাশিয়ার পক্ষ থেকে ঘোষিত যুদ্ধবিরতি সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনা নথিভুক্ত করছি এবং আমাদের মিত্রদের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করতে প্রস্তুত।” তিনি আরও যোগ করেন, “আসলে হয় পুতিন তার সেনাবাহিনীর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছেন না, অথবা পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে রাশিয়ার যুদ্ধ বন্ধ করার কোনো ইচ্ছা নেই। তাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো নিজেদের পক্ষে প্রচার করা।”

ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, “রাশিয়ান সেনাবাহিনী এমন একটি ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করছে যেন তারা যুদ্ধবিরতি পালন করছে, তবে কিছু কিছু এলাকায় তারা এখনো বিচ্ছিন্নভাবে অগ্রসরের চেষ্টা চালাচ্ছে।

যুদ্ধক্ষেত্রের ভিডিও ফুটেজেও ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টের এই দাবির সত্যতা পাওয়া গেছে। ডনেৎস্ক অঞ্চলের পোক্রোভস্ক এলাকার ইউস্পেনিভকা গ্রামের উপর সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী উড়তে দেখা গেছে।

এছাড়াও, কোস্তিয়ান্তিনিভকা শহরের কাছে জোরিয়া গ্রামে একটি মানবিক সহায়তা বহরেও রাশিয়ান বাহিনী হামলা চালিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এতে কমপক্ষে দুইজন বেসামরিক নাগরিক এবং প্রোলিখসা সাহায্য সংস্থার একজন কর্মী আহত হয়েছেন।

ইউক্রেনের ৩৭তম মেরিন ব্রিগেডের মুখপাত্র ডেনিস ববকোভ এক বিবৃতিতে জানান, “আমাদের জন্য, এটা যুদ্ধের মতোই একটি দিন ছিল – বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের শেলিং এবং এমনকি আমাদের অবস্থানের উপর আক্রমণের চেষ্টাও করা হয়েছে।” ববকোভের মতে, রবিবার দুপুর ২টা পর্যন্ত তার ব্রিগেড ১৬টি ড্রোন হামলা এবং দুটি আর্টিলারি হামলার ঘটনা রেকর্ড করেছে। তারা পোক্রোভস্কের দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং ডনেৎস্ক ও দিনপ্রোপেট্রোভস্ক অঞ্চলের প্রশাসনিক সীমান্তে অবস্থিত নভোপাভলিভকা গ্রামের কাছে যুদ্ধ করছে।

লাইমান শহরে অবস্থিত ৬৬তম ব্রিগেডও পদাতিক বাহিনীর আক্রমণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামতের চেষ্টা সম্পর্কে জানিয়েছে। তাদের মতে, “রাশিয়ানরা তথাকথিত ‘যুদ্ধ বিরতি’র সুযোগ নিচ্ছে তাদের কৌশলগত অবস্থান উন্নত করতে – পুনরায় সংগঠিত হয়ে আরও বড় আঘাত হানার জন্য।”

অন্যদিকে, মস্কোতে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করেছে যে ইউক্রেন ১,০০০ বারের বেশি যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। তাদের মতে, ৯০০টির বেশি ড্রোন হামলা হয়েছে, যার ফলে অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তবে, তারা বিস্তারিত কোনো তথ্য জানায়নি।

গত সপ্তাহে সুমি শহরের কেন্দ্রে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ৩৫ জন নিহত হওয়ার পর রবিবার ইউক্রেনীয় শহরগুলো তুলনামূলকভাবে শান্ত ছিল। কিয়েভের সেন্ট ভলোদিমির ক্যাথেড্রালে উপাসকরা সমবেত হয়েছিলেন এবং সেখানে পুরোহিতরা তাদের ইস্টার বাস্কেট পবিত্র জল দিয়ে আশীর্বাদ করেন।

মার্কেটিং পেশায় নিযুক্ত ৩৮ বছর বয়সী ওলগা গ্রাচোভা এ প্রসঙ্গে বলেন, “তারা ইতিমধ্যেই তাদের প্রতিশ্রুতি ভেঙেছে। দুর্ভাগ্যবশত, আমরা আজ রাশিয়ার উপর আস্থা রাখতে পারি না।”

এদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষের প্রতিই ক্রমশ ধৈর্য হারাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। শুক্রবার, ডোনাল্ড ট্রাম্প শান্তি আলোচনার চেষ্টা থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, “আমরা কাজটি সম্পন্ন করতে চাই।”

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীও সম্প্রতি ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে প্যারিসে মিলিত হয়ে কীভাবে এই যুদ্ধের সমাপ্তি টানা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সূত্রের খবর, হোয়াইট হাউস এমন একটি চুক্তির পক্ষে চাপ দিচ্ছে যা বিদ্যমান ১,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্রন্ট লাইনে সংঘাত বন্ধ করবে।

ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ প্রস্তাব দিয়েছেন যে ক্রিমিয়া এবং আরও চারটি ইউক্রেনীয় প্রদেশ রাশিয়াকে দেওয়া যেতে পারে। ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে এবং মস্কোকে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার মতো অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে।

জেলেনস্কির যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া জানায়নি ক্রেমলিন। তারা তাদের মূল যুদ্ধ লক্ষ্য অর্জনের উপর জোর দিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে জেলেনস্কিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরানো, দেশটির ‘সামরিকীকরণ’ করা এবং ন্যাটোতে যোগ না দেওয়ার নিশ্চয়তা আদায় করা।

হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছেন জেলেনস্কি। গত মাসে ইউক্রেন ৩০ দিনের মার্কিন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং খনিজ সম্পদ ব্যবহারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত।

তবে এমনো শোনা যাচ্ছে, হোয়াইট হাউসের রাশিয়া-পন্থী অবস্থানের কারণে জেলেনস্কি হতাশ হচ্ছেন। ট্রাম্প ইউক্রেনের উপর চাপ সৃষ্টি করেছেন, সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছেন এবং গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানও স্থগিত করেছেন, কিন্তু রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।

রবিবার জেলেনস্কি মার্কিন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক, ফক্স নিউজ-এর সমালোচনা করেন। কারণ, তারা মস্কোতে রাশিয়ার প্যাট্রিয়ার্কের সঙ্গে পুতিনের একটি অর্থোডক্স ইস্টার সার্ভিসের সরাসরি সম্প্রচার করে এবং ভুলভাবে কিয়েভকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে।

জেলেনস্কি তাঁর এক্সে (সাবেক টুইটার) লেখেন, “মস্কো থেকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করার পরিবর্তে, ফক্স নিউজের উচিত ছিল মস্কোকে সত্যিকারের যুদ্ধবিরতি পালনে বাধ্য করতে চাপ প্রয়োগ করা এবং ইস্টার শেষ হওয়ার পর অন্তত ৩০ দিন পর্যন্ত তা বজায় রাখতে বলা – যাতে কূটনীতি একটি বাস্তব সুযোগ পায়।”

ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফক্স নিউজের কাছে এর ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছে। মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, “যদি এটি ইচ্ছাকৃত রাজনৈতিক বিবৃতি না হয়ে কোনো ভুল হয়ে থাকে, তবে তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত এবং কে এই ভুল করেছে, তার তদন্ত করা উচিত।”

তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *