ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ: গাড়ির বাজারে কি ভয়ঙ্কর পরিবর্তন?

শিরোনাম: বাণিজ্য যুদ্ধ: আমেরিকার ‘চিকেন ট্যাক্স’ – এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব

বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় শুল্ক বা ট্যাক্সের প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘চিকেন ট্যাক্স’-এর ইতিহাসে।

১৯৬৩ সালে ইউরোপীয় দেশগুলোর পক্ষ থেকে মার্কিন মুরগির মাংসের ওপর শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এই ট্যাক্স চালু করে, যা মূলত হালকা ট্রাকের ওপর ধার্য করা হয়েছিল।

কয়েক দশক পেরিয়ে গেলেও, এই ট্যাক্স এখনও বহাল আছে এবং এর ফলস্বরূপ মার্কিন অর্থনীতির ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়েছে।

বাণিজ্য যুদ্ধের এই জটিলতা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যও শিক্ষণীয়।

শুরুতে, বিষয়টি ছিল মুরগি নিয়ে।

১৯৬২ সালে, ইউরোপীয় দেশগুলো মার্কিন মুরগির মাংসের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করে, যা ঐ অঞ্চলের বাজারে মার্কিন মাংসের প্রবেশ প্রায় বন্ধ করে দেয়।

এর জবাবে, ১৯৬৩ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন ইউরোপ থেকে আমদানি করা বিভিন্ন পণ্যের ওপর প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করেন।

এর মধ্যে ছিল হালকা ট্রাকও।

মূলত, জার্মান গাড়ি প্রস্তুতকারক ভক্সওয়াগন-কে লক্ষ্য করে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, কারণ সেই সময়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করার চেষ্টা করছিল।

এই ট্যাক্সের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিদেশি ট্রাকের প্রবেশ কঠিন হয়ে পড়ে।

এর সরাসরি সুবিধাভোগী হয় যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি প্রধান গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি—জেনারেল মোটরস, ফোর্ড এবং ক্রাইসলার।

বিদেশি প্রতিযোগিতার অভাবে তারা তাদের ট্রাকের দাম বাড়াতে শুরু করে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এই সময়ে আমেরিকান তৈরি ট্রাকের দাম বছরে ৫ থেকে ৬ শতাংশ হারে বাড়ছিল, যেখানে গাড়ির দাম বাড়ছিল মাত্র ২ শতাংশ।

এই ট্যাক্সের কারণে একদিকে যেমন বিদেশি ট্রাকের আমদানি কমে যায়, তেমনই অনেক বিদেশি কোম্পানি শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করতে শুরু করে।

উদাহরণস্বরূপ, কিছু কোম্পানি ট্রাকের বডি ছাড়াই যন্ত্রাংশ পাঠাতো, পরে যুক্তরাষ্ট্রে এসে বডি সংযোজন করত।

আবার, কেউ কেউ গাড়িতে অতিরিক্ত সিট যোগ করে সেটিকে যাত্রী পরিবহনের গাড়ির শ্রেণীতে ফেলত, যাতে শুল্কের পরিমাণ কমানো যায়।

এমনকি, ফোর্ড তাদের ইউরোপে তৈরি হওয়া ‘ট্রানজিট কানেক্ট’ ভ্যান-গুলোতে অতিরিক্ত সিট যুক্ত করে পাঠাতো, যা পরে কাস্টমসের ঝামেলা এড়ানোর জন্য সরিয়ে ফেলা হতো।

এই ধরনের কারসাজির জন্য ফোর্ডকে ২০১৪ সালে প্রায় ৩৬ কোটি ৫০ লক্ষ মার্কিন ডলার (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি) জরিমানা দিতে হয়।

তবে, ১৯৯৪ সালের নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (নাফটা)-এর মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার একটি নতুন পথ তৈরি হয়।

নাফটা কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক সহজ করে দেয়, ফলে গাড়ি প্রস্তুতকারকরা এই দুটি দেশেও তাদের ট্রাক তৈরি করতে শুরু করে এবং পরবর্তীতে তা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করতে থাকে।

‘চিকেন ট্যাক্স’-এর কারণে বিদেশি গাড়ি প্রস্তুতকারকরা যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ব্যবসার ধরন পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।

তারা হালকা ট্রাকের পরিবর্তে ছোট, জ্বালানি সাশ্রয়ী গাড়ির দিকে মনোযোগ দেয়।

১৯৭০-এর দশকে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমেরিকানরা এমন গাড়ির দিকে ঝুঁকতে শুরু করে।

১৯৮২ সালে হোন্ডা যখন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের কারখানা স্থাপন করে, তখন তারা প্রথমে গাড়ি তৈরি শুরু করে, ট্রাক নয়।

এই ‘চিকেন ট্যাক্স’-এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এখনো দৃশ্যমান।

যদিও এটি মূলত মার্কিন অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছিল, তবে এর থেকে বোঝা যায়, শুল্কনীতি কিভাবে একটি দেশের অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে।

শুল্ক আরোপের ফলে একদিকে যেমন স্থানীয় উৎপাদকরা সুবিধা পায়, তেমনি ভোক্তাদের জন্য পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে এবং বাজারের স্বাধীনতা কমে যাওয়ারও সম্ভবনা থাকে।

অতএব, বাণিজ্য যুদ্ধ এবং শুল্কনীতি একটি জটিল বিষয়।

এই ধরনের নীতি গ্রহণের সময় দেশের অর্থনীতির ওপর এর সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবগুলো বিবেচনা করা জরুরি।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং শুল্কনীতির জটিলতা সম্পর্কে অবগত থাকা এবং দেশের অর্থনীতির স্বার্থে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *