উচ্চ মানের রান্নার জগতে মিশেলিন তারকার খ্যাতি জগৎজোড়া। রেস্তোরাঁগুলোকে এই তারকা এনে দেয় সম্মান ও স্বীকৃতি। কিন্তু এই সম্মান কি সবসময় আনন্দের? নাকি কিছু ক্ষেত্রে তা অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়? সম্প্রতি, এই বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
ইউরোপ এবং আমেরিকার অনেক নামী শেফ এবং রেস্তোরাঁ মালিক এখন মিশেলিন তারকার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। ইতালির লুকা শহরের ‘গিগলিও’ নামক একটি রেস্তোরাঁর মালিক, বেনেদেত্তো রুুলো, তাদের একটি তারকা সরিয়ে নেওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। তার মতে, এই তারকা তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
কারণ, অনেক গ্রাহক ‘ফরমাল’ পরিবেশ এবং কঠিন মেনু’র ভয়ে সেখানে যেতে চাইতেন না। রুুলোর মতে, “উচ্চমানের রেস্তোরাঁতে টি-শার্ট, ফ্লিপ-ফ্লপ এবং শর্টস পরে যাওয়ার স্বাধীনতা থাকা উচিত।”
ফ্রান্সেও এমন ঘটনা ঘটেছে। শেফ মার্ক ভেয়রাঁ তার নতুন রেস্তোরাঁতে মিশেলিন পরিদর্শকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন। এর আগে, ২০১৯ সালে তার একটি রেস্তোরাঁ থেকে একটি তারকা সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
কারণ হিসেবে জানা যায়, পরিদর্শকরা অভিযোগ করেছিলেন, তিনি সুফলের মধ্যে চিজ ব্যবহার করেছেন। ভেয়রাঁ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন, তবে তিনি হেরে যান। মিশেলিন কর্তৃপক্ষ তাকে ‘আত্ম-প্রেমী তারকা’ বলেও অভিহিত করে।
মিশেলিন তারকা সাধারণত রেস্তোরাঁর ব্যবসা বাড়াতে সাহায্য করে। একটি তারকা ২০%, দুটি ৪০% এবং তিনটি তারকা পেলে ব্যবসা ১০০% পর্যন্ত বাড়ে। তাহলে কেন কিছু শেফ এই খ্যাতি থেকে দূরে থাকতে চান?
এর কারণ হলো, এই তারকা ধরে রাখা বেশ কঠিন। খ্যাতি ধরে রাখতে হলে অনেক চাপ সহ্য করতে হয়, যা অনেক সময় কষ্টের কারণ হয়।
আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টের রেস্তোরাঁ মালিক মাইকেল ডিন-এর কথাই ধরুন। প্রায় ৩০ বছর আগে তিনি প্রথম মিশেলিন তারকা পেয়েছিলেন। তিনি আরও কয়েকটি রেস্তোরাঁ খোলেন।
কিন্তু তার প্রধান শেফ চলে যাওয়ার পর তিনি নতুন করে সমস্যার সম্মুখীন হন। একদিকে তিনি ভালো মানের শেফ নিয়োগ করতে দ্বিধা বোধ করছিলেন, কারণ তাতে অনেক খরচ হতো।
অন্যদিকে, তিনি আবার রান্নাঘরে ফিরতে চাইছিলেন না। ডিন-এর ভাষায়, “এটা ছিল খুবই কঠিন একটা সিদ্ধান্ত।” শেষ পর্যন্ত তিনি তার রেস্তোরাঁটি সংস্কার করেন এবং মেনু পরিবর্তন করেন।
তিনি এমন সব খাবার পরিবেশন করতে শুরু করেন যা শেফদের চোখে ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, যেমন – ‘চিকেন উইংস’, ‘বার্গার’ ইত্যাদি। ডিন স্বীকার করেন, তার তারকা হারানোর দুঃখ আছে।
তবে, শুধু শেফরাই নন, অনেক ভোজনরসিকও এখন মিশেলিন তারকার প্রতি আগের মতো আকৃষ্ট নন। কারণ, এখন গুগল রিভিউ, বিভিন্ন ফুড ব্লগার এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব অনেক বেড়েছে।
তারা তাদের নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেন, যা গ্রাহকদের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
মিশেলিন তারকার ধারণাটি মূলত পশ্চিমা বিশ্বের, যেখানে খাবারের গুণমান বিচারের একটি পদ্ধতি রয়েছে। বাংলাদেশে যদিও এমন কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই, তবে খাবারের মান এবং গ্রাহক সন্তুষ্টির দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়।
সম্প্রতি, মিশেলিন গাইড তাদের মানদণ্ডেও কিছু পরিবর্তন এনেছে। তারা পরিবেশ-বান্ধব রেস্তোরাঁগুলোকে ‘সবুজ তারকা’ দেওয়া শুরু করেছে এবং বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের কার্যক্রম প্রসারিত করছে।
তবে, এই পরিবর্তনগুলো সবসময় সফল হয়নি।
বর্তমানে, খাবারের জগতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। গ্রাহকরা এখন দ্রুত এবং সহজলভ্য খাবার পছন্দ করেন। দামও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই, হয়তো ভবিষ্যতে মিশেলিন তারকার গুরুত্ব আগের মতো নাও থাকতে পারে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান