পেরুর আমাজন অঞ্চলের আদিবাসী নেত্রী মারি লুস কানাকিরি মুরায়ারি মর্যাদাপূর্ণ গোল্ডম্যান পরিবেশ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার নেতৃত্বে পরিচালিত এক সফল আইনি লড়াইয়ের ফলস্বরূপ, কুকামা সম্প্রদায়ের জীবনধারণের অবিচ্ছেদ্য অংশ মারানন নদীকে “বৈধ ব্যক্তি” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
মারি লুস কানাকিরি, যিনি ৫৬ বছর বয়সী এবং মারানন নদীর তীরে অবস্থিত শাপাজিলা গ্রামের বাসিন্দা, হুয়াইকানানা কামাতাউয়ারা কানা (এইচকেকে) নারী সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। পেরুর লিগ্যাল ডিফেন্স ইনস্টিটিউটের আইনজীবীদের সহায়তায় তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ আইনি লড়াইটি পরিচালনা করেন। এই সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য ছিল মারানন নদীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা। আদিবাসী কুকামা সম্প্রদায়ের মানুষজন এই নদীকে তাদের জীবন ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন। তাদের বিশ্বাস, নদীর গভীরে তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মা বাস করে।
২০২৪ সালের মার্চ মাসে, লরেটো অঞ্চলের একটি আদালত ঐতিহাসিক রায় দেয়। এই রায়ে বলা হয়, মারানন নদীর মুক্ত প্রবাহ এবং দূষণমুক্ত থাকার অধিকার রয়েছে। আদালতের মতে, পেরু সরকার নদীর অধিকার লঙ্ঘন করেছে এবং অবিলম্বে ভবিষ্যতে তেল নিঃসরণ বন্ধ করতে ব্যবস্থা নিতে হবে। একইসঙ্গে, পুরো নদী অববাহিকার জন্য একটি সুরক্ষা পরিকল্পনা তৈরি এবং কুকামা সম্প্রদায়কে নদীর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। যদিও সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিল, কিন্তু অক্টোবরে আদালত তাদের পূর্বের রায় বহাল রাখে।
মারি লুস কানাকিরি বলেন, “নদী হলো মায়ের মতো। মারানন নদী আন্দিজ পর্বতমালায় জন্ম নেয় এবং পরে আমাজন নদীতে মিলিত হয়।
কুকামা সম্প্রদায়ের মানুষ যুগ যুগ ধরে তেল নিঃসরণের কারণে ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হয়েছে। এর ফলে মাছের উৎপাদন কমে গেছে, পরিবেশ দূষিত হয়েছে এবং পানিতে ভারী ধাতুর মিশ্রণ ঘটেছে। স্থানীয়রা জ্বর, ডায়রিয়া, চর্মরোগ এবং গর্ভপাতের মতো স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। এমনকি, ২০২১ সালের এক গবেষণায় নদীর কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষের শরীরে সীসা, পারদ, আর্সেনিক এবং ক্যাডমিয়ামের উচ্চমাত্রার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
মারি লুস, যিনি চার সন্তানের মা এবং ছয় নাতির দিদিমা, শৈশবের স্মৃতিচারণ করে বলেন, “তেল খনন শুরুর আগে আমাদের জীবনে প্রচুর খাবার ছিল। আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করতাম, উৎসব উদযাপন করতাম।
তবে, এই আইনি সাফল্যের পরেও নদীর সুরক্ষা এখনো নিশ্চিত হয়নি। মারি লুস এবং এইচকেকে সংগঠন পেরু সরকারকে আদালতের রায় কার্যকর করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। সম্প্রতি পেরুর কংগ্রেসে একটি এনজিও-বিরোধী আইন পাস হয়েছে, যা পরিবেশ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কার্যক্রমকে সীমিত করতে পারে। মারি লুস আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “এই আইন আমাদের আইনি লড়াইকে দুর্বল করে দিতে পারে।
তিনি আরও যোগ করেন, “এটা কেবল আমাদের জন্য নয়, দেশের এবং বিশ্বের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। শ্বাসপ্রশ্বাস ছাড়া যেমন কেউ বাঁচতে পারে না, তেমনি আমাজন, বন এবং নদী ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। প্রতিদিনের খাদ্য, ফল, সবজি, মাছ—এগুলো আমরা কোথা থেকে পাবো?”
মারি লুসের মতে, তিনি এবং এইচকেকে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, “সরকারের বোঝা উচিত যে প্রকৃতির ধ্বংস করা উচিত নয়, বরং একে রক্ষা করতে হবে। অন্যথায়, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আর কি অবশিষ্ট থাকবে?”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান