পোপ ফ্রান্সিসের প্রয়াণের পর নতুন পোপ নির্বাচনের প্রক্রিয়া এখন আলোচনার কেন্দ্রে। ক্যাথলিক চার্চের প্রধান হিসেবে তাঁর উত্তরসূরি কে হবেন, সেই বিষয়ে জল্পনা বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। এই নির্বাচনের পদ্ধতি, সম্ভাব্য প্রার্থী এবং এর তাৎপর্য নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদন।
রবিবার সকালে ভ্যাটিকান সিটি ঘোষণা করে যে পোপ ফ্রান্সিস ৮৮ বছর বয়সে মারা গেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন এবং তাঁর শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে চিকিৎসা চলছিল। পোপের মৃত্যু, যা তাঁর ১২ বছরের পোপীয় শাসনের সমাপ্তি ঘটায়, বিশ্বের বৃহত্তম এই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। বর্তমানে ক্যাথলিক চার্চের অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ১৩৯ কোটিরও বেশি।
নতুন পোপ নির্বাচনের দায়িত্ব হলো কার্ডিনালদের। এই কার্ডিনালরা সাধারণত চার্চের শীর্ষস্থানীয় ধর্মগুরুদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত হন এবং তাঁদের অধিকাংশই পোপ ফ্রান্সিস নিজেই নিয়োগ করেছিলেন। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ২৪০ জনের বেশি কার্ডিনাল রয়েছেন। সাধারণত, কার্ডিনালরা আজীবন এই পদে থাকেন। তবে, পোপের মৃত্যুর পর বা পদত্যাগের সময় ৮০ বছরের কম বয়সী কার্ডিনালরা নতুন পোপ নির্বাচনের জন্য ভোট দিতে পারেন। এই প্রক্রিয়াটি ‘পোপাল কনক্লেভ’ নামে পরিচিত।
পোপ নির্বাচনের জন্য কার্ডিনালরা গোপন কক্ষে মিলিত হন, যা সিস্টিন চ্যাপেল নামে পরিচিত। এখানে বাইরের কারও কোনো প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থাকে না। সাধারণত, ১২০ জন কার্ডিনাল এই নির্বাচনে ভোট দেওয়ার যোগ্য হন, তবে বর্তমানে এই সংখ্যা ১৩৮। গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা হয় এবং এই প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করেন নয়জন নির্বাচিত কার্ডিনাল। নতুন পোপ নির্বাচনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হয়। প্রতিবার ভোটের পর ব্যালটগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সাদা ধোঁয়া উঠলে বোঝা যায় নতুন পোপ নির্বাচিত হয়েছেন, আর কালো ধোঁয়া উঠলে সিদ্ধান্ত হয়নি। নতুন পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর শীর্ষস্থানীয় কোনো কার্ডিনাল সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা থেকে তাঁর নাম ঘোষণা করেন।
সাধারণত, পোপের মৃত্যুর বা পদত্যাগের দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর কারণ হলো, শোকের জন্য নয় দিনের একটি সময়সীমা থাকে এবং বিশ্বজুড়ে থাকা কার্ডিনালদের ভ্যাটিকানে আসতে হয়। ২০১৩ সালে, পোপ ফ্রান্সিসকে নির্বাচনের জন্য কনক্লেভ শুরু হয়েছিল তাঁর পূর্বসূরি ষোড়শ বেনেডিক্টের পদত্যাগের মাত্র ১২ দিন পর।
এই নির্বাচন প্রক্রিয়া কয়েক দিন, সপ্তাহ বা তার বেশি সময় পর্যন্ত চলতে পারে। কার্ডিনালদের মধ্যে মতপার্থক্যের ওপর এর সময় নির্ভর করে। প্রতিদিন কনক্লেভে সর্বোচ্চ চারবার ভোট হতে পারে। যদি ৩৩ বার ভোটের পরও কোনো সিদ্ধান্ত না আসে, তাহলে শীর্ষ দুই প্রার্থীর মধ্যে চূড়ান্ত ভোট হয়।
ইতিহাসে দেখা যায়, কোনো কোনো পোপ নির্বাচন দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে। ১২৭১ সালে পোপ গ্রেগরি একাদশকে নির্বাচনের জন্য কনক্লেভ প্রায় তিন বছর ধরে চলেছিল। পোপ নির্বাচনের জন্য যোগ্য ১৩৮ জন কার্ডিনালের মধ্যে ১১০ জনকে পোপ ফ্রান্সিস নিয়োগ করেছেন। এই দলে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার প্রতিনিধিদের সংখ্যা বেশি, যা চার্চের বিশ্বব্যাপী বিস্তারের প্রতিফলন। সবচেয়ে কম বয়সী কার্ডিনাল নির্বাচকের বয়স মাত্র ৪৫ বছর, যিনি অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করেন এবং ইউক্রেনের নাগরিক।
এই কারণে, এমন সম্ভাবনা রয়েছে যে, বহু শতাব্দী পর এবারই প্রথম আফ্রিকা বা এশিয়া থেকে কোনো পোপ নির্বাচিত হতে পারেন। সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে ঘানার পিটার টার্কসন, যিনি একসময় জাস্টিস অ্যান্ড পিস বিষয়ক পোপীয় কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন, এবং কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের ফ্রিডোলিন আমবোঙ্গো অন্যতম। ফিলিপাইনের কার্ডিনাল লুইস তাগলে-র নামও শোনা যাচ্ছে, যিনি পোপ ফ্রান্সিসের মতোই সামাজিক ন্যায়বিচারের ওপর জোর দেন। এছাড়াও, হাঙ্গেরির কার্ডিনাল পিটার এরদো, যিনি রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত, এবং ভ্যাটিকানের সেক্রেটারি অফ স্টেট কার্ডিনাল পিয়েত্রো পারোলিনের নামও আলোচনায় রয়েছে।
পোপের পদ শূন্য থাকা অবস্থায়, একজন সিনিয়র কার্ডিনাল, যিনি ক্যামেরলেনগো নামে পরিচিত, পোপের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং ভ্যাটিকানের আর্থিক ও প্রশাসনিক বিষয়গুলো সাময়িকভাবে দেখাশোনা করেন। বর্তমান ক্যামেরলেনগো হলেন আইরিশ বংশোদ্ভূত কার্ডিনাল কেভিন ফারেল।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা