ফ্রান্সিস: সংস্কারে প্রতিরোধের মুখে পড়া ‘বহিরাগত’ পোপ!

পোপ ফ্রান্সিস: দরিদ্রের বন্ধু, সংস্কারপন্থী এবং এক ব্যতিক্রমী নেতার প্রয়াণ।

বিশ্বজুড়ে ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মগুরু, পোপ ফ্রান্সিস, ৮৮ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন। তিনি ছিলেন আর্জেন্টিনার নাগরিক এবং ক্যাথলিক চার্চের ইতিহাসে প্রথম লাতিন আমেরিকান পোপ।

দরিদ্র মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি, সংস্কারের সাহসী পদক্ষেপ এবং একটি উদার চার্চের ধারণা—এসবের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন এমন একজন যিনি প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন। তিনি শুধু প্রথম লাতিন আমেরিকান পোপই ছিলেন না, বরং ক্যাথলিক চার্চের ইতিহাসে প্রথম জেসুইট সম্প্রদায়ের প্রধানও ছিলেন।

এমনকি, তিনি ফ্রান্সিস নাম ধারণকারীও প্রথম পোপ ছিলেন। পোপ হওয়ার আগে তিনি কখনোই রোমে বসবাস করেননি বা কাজ করেননি।

পোপ ফ্রান্সিসের সংস্কারপন্থী পদক্ষেপগুলো চার্চের অভ্যন্তরে এবং বাইরের রক্ষণশীল মহলে তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল। তিনি সবসময় একটি মানবিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক চার্চের স্বপ্ন দেখতেন।

এই লক্ষ্যে, তিনি ভ্যাটিকানের সাধারণ গেস্ট হাউসে থাকতেন, পোপের রাজকীয় বাসভবনে নয়।

২০১৩ সালের ১৩ই মার্চ, পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি বিশ্ববাসীর কাছে ভ্রাতৃত্বের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে তাদের সাধারণ মানবিকতা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন।

বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরিতেও তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ।

পোপ ফ্রান্সিস এমন এক সময়ে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন যখন ভ্যাটিকান গুরুতর সংকটের মধ্যে ছিল। এর আগে, ষোড়শ বেনেডিক্ট সংস্কার করতে না পেরে পদত্যাগ করেছিলেন।

এছাড়া, ভ্যাটিকান ব্যাংকের আর্থিক কেলেঙ্কারি এবং শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ চার্চকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। পোপ ফ্রান্সিস দ্রুত ব্যাংক সংস্কারের উদ্যোগ নেন এবং ভ্যাটিকানের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনেন।

তাঁর সময়েই প্রথম কোনো কার্ডিনালকে আর্থিক অপরাধের জন্য ভ্যাটিকান আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়।

তিনি চার্চের অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার জন্য একটি নতুন সংবিধান তৈরি করেন। এর মাধ্যমে, তিনি কর্তৃত্বপূর্ণ কাঠামো থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামোর দিকে জোর দেন।

তিনি প্রায়ই অপ্রত্যাশিত মন্তব্য করতেন, যা অনেক সময় রক্ষণশীলদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করত।

পোপ প্রায়ই চার্চের ‘অভিজাত’ এবং ‘পশ্চাৎপদ’ ধারণার অনুসারীদের সমালোচনা করতেন। তাঁর এই সমালোচনা অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীলদের মধ্যে, শত্রুতা তৈরি করেছিল।

তিনি গর্ভপাত, সমকামিতা এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মতো বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার পরিবর্তে দরিদ্র, অভিবাসী এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেন।

পোপ ফ্রান্সিস তাঁর ভুলগুলো স্বীকার করতেও দ্বিধা করেননি। তিনি শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো মোকাবিলায়ও পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসে ১৯৩৬ সালের ১৭ই ডিসেম্বর জর্জে মারিও বেরগোগলিও জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ছিল ইতালীয় বংশোদ্ভূত।

তিনি একটি ঘনিষ্ঠ পরিবারে বেড়ে ওঠেন এবং তাঁর ঠাকুরমা তাঁর ধর্মীয় জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন।

পোপ ফ্রান্সিস সবসময় দরিদ্র ও আশ্রয়প্রার্থীদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন। তিনি ইতালির ল্যাম্পেদুসা দ্বীপে অভিবাসীদের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখতে যান।

তিনি বিশ্বের ক্যাথলিক সম্প্রদায়কে অভিবাসী পরিবারগুলোকে আশ্রয় দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি লিবিয়ার শরণার্থী শিবিরগুলোকে ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের’ সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।

পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রেও পোপ ফ্রান্সিসের অবদান ছিল। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগের বিষয়টি তুলে ধরেন এবং ধনী দেশগুলোকে তাদের দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান।

পোপ ফ্রান্সিস আন্তঃধর্মীয় সংলাপের ওপর জোর দিতেন। তিনি মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করেছেন। তিনি মিশরের আল-আজহারের গ্র্যান্ড ইমাম আহমেদ আল-তাইয়েবের সঙ্গে ‘মানব ভ্রাতৃত্ব’ বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

এছাড়া, তিনি ইরাক এবং ইন্দোনেশিয়াতেও আন্তঃধর্মীয় সংলাপে অংশ নেন।

পোপ ফ্রান্সিস ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ বন্ধের জন্য এবং ইউক্রেন যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধানেও প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।

পোপ ফ্রান্সিসের সংস্কারগুলো অনেক সময় প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। রক্ষণশীলরা তাঁকে ঐতিহ্য ও মতাদর্শের পরিপন্থী বলে অভিযোগ করেন।

তিনি মহিলাদের যাজক পদে নিয়োগের বিরোধিতা করেছিলেন এবং বিবাহিত পুরুষদের যাজক হওয়ার অনুমতি দেননি।

যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া শিশুদের বিষয়ে পোপ ফ্রান্সিস শুরু থেকেই সংবেদনশীল ছিলেন। তিনি এই ধরনের ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন।

২০২৩ সালে, পোপ ফ্রান্সিস সমকামী যুগলদের আশীর্বাদ করার অনুমতি দেন, যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তিনি এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেন এবং তাঁদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধের আহ্বান জানান।

কোভিড-১৯ মহামারীর সময় পোপ ফ্রান্সিস তাঁর প্রার্থনা সরাসরি সম্প্রচার করতেন। তিনি দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

পোপ ফ্রান্সিসের জীবন এবং কর্ম একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তিনি এমন একজন নেতা ছিলেন যিনি বিশ্বকে আরও সুন্দর এবং মানবিক করে তোলার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *