মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক রোগ নির্ণয়: গভীর উপলব্ধির নতুন দিগন্ত?
আজকাল, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা চলছে, তবে অনেক সময় মনে হয় যেন আমরা একে অপরের সাথে কথা না বলে, তর্ক করছি। অনেক সময় শোনা যায়, মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাগুলোকে ‘অতিরিক্ত রোগ নির্ণয়’ করা হচ্ছে।
কারো কারো মতে, এর ফলে অনেক মানুষকে ‘প্রান্তিক’ করে দেওয়া হচ্ছে। আমার মনে হয়, এই বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা জরুরি, কারণ এটি কেবল একটি উন্নত জীবন গঠনের জন্যই নয়, বরং একটি উন্নত সমাজ গঠনের চাবিকাঠিও বটে।
চিকিৎসাগত রোগ নির্ণয় মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে। একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে, আমি আমার সহকর্মীদের দক্ষতা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং সহানুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
যখন সবকিছু ঠিকঠাক কাজ করে, তখন একটি রোগ নির্ণয় আমাদের অনেক স্বস্তি দিতে পারে। এটি উপযুক্ত থেরাপি এবং ঔষধের পথ খুলে দেয় এবং নিজের অভিজ্ঞতার একটি নাম খুঁজে পাওয়া অনেক মূল্যবান হতে পারে।
কিন্তু, সবসময় রোগ নির্ণয় উপকারী নাও হতে পারে। আমার মনে হয়, আমরা সবাই রোগ নির্ণয়কে একটি দরজা বন্ধ করার উপায় হিসেবে ব্যবহার করি, যা আসলে খোলা উচিত।
উদাহরণস্বরূপ, বিষণ্ণতা বা ওসিডি (অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার) অথবা অটিজম-এর মতো রোগ নির্ণয়, আমাদের নিজেদের ভেতরের গভীর অনুসন্ধানে বাধা দেয়। অনেক সময়, আমরা আমাদের ব্যক্তিগত ইতিহাস, সম্পর্ক এবং কষ্টের গভীরে না গিয়ে, একটি রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি।
এভাবে মনের দরজা বন্ধ করে দিলে, একটি সুন্দর জীবন গড়ার সম্ভাবনাও কমে যায়।
ধরুন, কারো এডিএইচডি (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারএকটিভিটি ডিসঅর্ডার) হয়েছে। এই রোগ নির্ণয় অনেক মানুষের কাছে তাদের জীবনের একটি দীর্ঘ প্রশ্নের উত্তর হিসাবে আসে।
তারা মনে করেন, এতদিন ধরে তারা যে সমস্যাগুলো অনুভব করছিলেন, সেগুলোর একটি ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে।
তবে, আমার রোগীদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখেছি, রোগ নির্ণয় আসলে একটি উত্তরের চেয়েও বেশি কিছু – এটি নতুন একটি প্রশ্নের সূচনা করে। এডিএইচডি কিছু উপসর্গের সমষ্টি মাত্র।
অভিজ্ঞতা এবং গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঔষধ হয়তো এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে, এবং এর পেছনে কিছু জিনগত ও স্নায়ু-সংক্রান্ত কারণ থাকতে পারে। কিন্তু এখানেই সব শেষ নয়।
একজন ব্যক্তি, এই রোগ নির্ণয়ের গভীরে গিয়ে নিজেকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারেন। তিনি হয়তো খুঁজে বের করতে পারেন, কেন তিনি সময়মতো কাজ শেষ করতে পারেন না, কেন একটি মিটিংয়ে তার দেরি হয়, বা কেন তিনি অস্থির থাকেন।
থেরাপির মাধ্যমে, এই সমস্যাগুলো আরও গভীর ভাবে বোঝা যেতে পারে, যা আমাদের আত্ম-উপলব্ধিকে আরও গভীর করে তোলে।
যেমন, গভীর মনোবিশ্লেষণমূলক থেরাপিতে একজন ব্যক্তি তার ভেতরের অনুভূতিগুলো চিহ্নিত করতে পারেন। তারা বুঝতে পারেন, কোন বিষয়গুলো তাদের কষ্ট দেয় এবং কেন তারা সেই কষ্টগুলো এড়াতে চান।
এই ধরনের থেরাপি সময়সাপেক্ষ, তবে এর ফল অনেক গভীর হতে পারে।
এই ধরনের থেরাপির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সম্ভব। অনেক রোগী, যাদেরকে ‘প্রান্তিক’ করে দেওয়া হয়েছিল, তারা তাদের ভেতরের শক্তি খুঁজে পান এবং তাদের সমস্যাগুলো কোথা থেকে আসছে, তা বুঝতে পারেন।
তারা নিজেদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারেন এবং তাদের কষ্টগুলো মোকাবিলা করতে পারেন।
দুর্ভাগ্যবশত, আমি এখনো এমন কোনো পরিকল্পনা দেখিনি যেখানে সরকার দীর্ঘমেয়াদী মনোবিশ্লেষণমূলক থেরাপির জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করবে। এমন অনেক প্রমাণ আছে যা দেখায় যে, এই ধরনের থেরাপি দীর্ঘমেয়াদী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন – চিকিৎসা-প্রতিরোধী বিষণ্ণতা (treatment resistant depression) কমাতে সাহায্য করতে পারে।
তবে সম্ভবত, স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, এটি তাদের সমস্যার ‘রোগ নির্ণয়ে’ উপযুক্ত নয়। তারা হয়তো আর্থিক বিষয়গুলোর দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন, কিন্তু ভালো থেরাপিস্টদের প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করলে যে দীর্ঘমেয়াদী উপকার পাওয়া যেতে পারে, সেদিকে তাদের তেমন নজর নেই।
আমাদের সমাজ এবং ব্যক্তি হিসেবে এটা খুবই দুঃখজনক। কারণ, একদিকে যখন একজন ব্যক্তির সুযোগ-সুবিধা কমানোর কথা বলা হয়, তখন তাদের ভালো জীবন গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা হয়।
তথ্য সূত্র: The Guardian