গুগলের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ, সার্চ ইঞ্জিনের ভবিষ্যৎ কী?

যুক্তরাষ্ট্রের সরকার গুগলকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছে, কারণ তারা মনে করে প্রযুক্তি জায়ান্টটি তাদের সার্চ ইঞ্জিন ব্যবসার একচেটিয়া অধিকার (monopoly) তৈরি করেছে, যা আইনের পরিপন্থী। এই ঘটনার জেরে, কিভাবে গুগলকে শাস্তি দেওয়া যায় সে বিষয়ে শুনানির জন্য ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি আদালত বসেছে। এই মামলাটি এখন এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিয়েছে, যেখানে গুগলের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হতে পারে।

শুনানিতে, যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ (Department of Justice) গুগলকে তাদের প্রভাবশালী অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (artificial intelligence) ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির জন্য আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছে। বিচার বিভাগের আইনজীবী ডেভিড ডালকুইস্ট শুনানিতে বলেন, “এই মুহূর্তে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। আমরা কি সার্চ বাজারটি একচেটিয়া অধিকারের হাতে ছেড়ে দেব, নাকি প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করব এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুযোগ তৈরি করব?”

আদালতে বিচার বিভাগ গুগলের বিরুদ্ধে বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপের প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, অ্যাপল এবং অন্যান্য প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির সঙ্গে গুগলের করা বিলিয়ন ডলারের চুক্তি বাতিল করা, যা তাদের সার্চ ইঞ্জিনকে প্রতিযোগীদের থেকে আলাদা করে রাখে। এছাড়াও, ব্যবহারকারীর গুরুত্বপূর্ণ ডেটা (data) প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে শেয়ার করতে এবং জনপ্রিয় ক্রোম ব্রাউজার (Chrome browser) বিক্রি করতে বাধ্য করা হতে পারে।

তবে, গুগলের আইনজীবী জন স্কিডলেইন আদালতের কাছে আবেদন করেছেন, যেন তারা এই বিষয়ে নমনীয় হন। তিনি যুক্তি দেন, সরকারের প্রস্তাবিত কঠোর পদক্ষেপগুলি প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করবে না, বরং দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বীদের অন্যায়ভাবে সুবিধা দেবে। স্কিডলেইন আরও বলেন, “গুগল ন্যায্যভাবেই বাজারে তাদের স্থান অর্জন করেছে।”

এই মামলার সূত্রপাত হয় ২০২০ সালে, যখন বিচার বিভাগ গুগলের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। অভিযোগ ছিল, গুগল তাদের সার্চ ইঞ্জিনকে একচেটিয়া ক্ষমতা ব্যবহার করে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রতিযোগিতাকে দমিয়ে রেখেছে। ২০২৩ সালে মামলার শুনানিতে, আদালত রায় দেয় যে গুগল তাদের সার্চ ইঞ্জিনকে আইফোন, কম্পিউটার এবং অ্যান্ড্রয়েড-চালিত ডিভাইসগুলিতে একচেটিয়াভাবে ব্যবহারের জন্য কিছু চুক্তি (anti-competitive deals) করেছিল।

এই মামলার রায় গুগলের জন্য একটি বড় ধাক্কা, যা তাদের ভবিষ্যতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। গুগলের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ এবং সের্গেই ব্রিন ১৯৯৮ সালে সিলিকন ভ্যালির একটি গ্যারেজে এই কোম্পানিটি শুরু করেন। বর্তমানে গুগল ইমেইল, ডিজিটাল ম্যাপিং, অনলাইন ভিডিও, ওয়েব ব্রাউজিং, স্মার্টফোন সফটওয়্যার এবং ডেটা সেন্টারের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাবশালী অবস্থানে রয়েছে।

বিচার বিভাগ এখন প্রমাণ করতে চাইছে যে গুগলের এই বিশাল ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। বিচার বিভাগের মতে, “গুগলের অবৈধ কার্যকলাপ একটি অর্থনৈতিক দৈত্য তৈরি করেছে, যা বাজারের উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং গুগলকে সব পরিস্থিতিতে জিততে সাহায্য করে।”

শুনানিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (artificial intelligence) বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, এই প্রযুক্তি ইন্টারনেটে তথ্য অনুসন্ধানের পদ্ধতিকে নতুন রূপ দিতে পারে। বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা চায় গুগলের জেমিনি (Gemini), যা জেনারেটিভ এআই (generative AI) প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি, তা যেন গুগলের বিদ্যমান সার্চ একচেটিয়া অধিকারকে আরও শক্তিশালী করতে ব্যবহার করা না হয়।

গুগলের আইনজীবীরা অবশ্য তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, প্রস্তাবিত ব্যবস্থাগুলি ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তার ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তারা আরও বলেছে, এই ধরনের পদক্ষেপ ব্রাউজার ডেভেলপারদের ক্ষতিগ্রস্থ করবে এবং কোটি কোটি ব্যবহারকারীর ডিজিটাল নিরাপত্তা বিপন্ন করবে।

এই মামলাটি ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে মাইক্রোসফটের বিরুদ্ধে আনা মামলার মতোই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে কোম্পানিটিকে তাদের উইন্ডোজ সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের ধ্বংস করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল।

গুগল এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার পরিকল্পনা করছে, তবে প্রতিকার শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা তা করতে পারবে না। শুনানির শেষে, বিচারক আগামী গ্রীষ্মের শেষ নাগাদ এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন।

এছাড়াও, বিচার বিভাগ গুগলের ডিজিটাল বিজ্ঞাপন নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধেও একটি আলাদা মামলা করেছে, যেখানে তারা একই ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এনেছে। এই মামলার ফলস্বরূপ, গুগলের বিরুদ্ধে আরও একটি প্রতিকার শুনানি হতে পারে, যা সম্ভবত তাদের ভেঙে দেওয়ার সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দেবে।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *