পাকিস্তানের শীর্ষ কর্মকর্তার কাবুল সফর: শান্তির বার্তা?

পাকিস্তানের প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে ইসলামাবাদ। গত এক বছর ধরে চলা তিক্ততা কমাতে সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনা শুরু হয়েছে।

তারই ধারাবাহিকতায়, পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার গত ১৯শে এপ্রিল কাবুল সফর করেন। ফেব্রুয়ারি ২০২৩ এর পর এটি ছিল কোনো শীর্ষ পাকিস্তানি কর্মকর্তার প্রথম আফগানিস্তান সফর।

আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতা দখলের পর থেকেই প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করে। সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

এছাড়া, আফগান শরণার্থীদের বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত এবং সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুই দেশই এখন আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাইছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, কাবুলে ইসহাক দার আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে নিরাপত্তা, বাণিজ্য, ট্রানজিট, যোগাযোগ এবং দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

তবে, আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা উদ্বেগের কথা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। তারা মূলত আফগান শরণার্থী, রাজনৈতিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বাণিজ্য, এবং যৌথ প্রকল্পগুলোর ওপর জোর দিয়েছে।

বৈঠকের পর কাবুলে এক সংবাদ সম্মেলনে ইসহাক দার জানান, পাকিস্তান আফগান কর্মকর্তাদের ইসলামাবাদে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানে খোলামেলা আলোচনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে।

তিনি আরও বলেন, “আমরা আমাদের স্বাগতিকদের অনুরোধ করেছি, এই অঞ্চলের উন্নতি, সমৃদ্ধি এবং শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমরা যেমন কাউকে আমাদের মাটি ব্যবহার করে আফগানিস্তানে অবৈধ কার্যকলাপ করতে দেব না, তেমনি আপনারাও আপনাদের মাটি ব্যবহার করতে দেবেন না।”

আফগানিস্তানে তালিবানের ক্ষমতা গ্রহণের পর, বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখাওয়া এবং বেলুচিস্তান প্রদেশে সন্ত্রাসী হামলা বেড়ে যাওয়ায় পাকিস্তান উদ্বিগ্ন। ইসলামাবাদ দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে, আফগান ভূমি ব্যবহার করে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো, বিশেষ করে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) সীমান্ত পেরিয়ে হামলা চালাচ্ছে।

টিটিপি’র উত্থান হয় ২০০৭ সালে। তারা আদর্শিকভাবে আফগানিস্তানের তালিবানের সঙ্গে মিল রাখলেও, সংগঠনটি স্বাধীনভাবে কাজ করে। যদিও তালিবান বরাবরই টিটিপির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করে আসছে।

ইসলামাবাদভিত্তিক গবেষণা সংস্থা, পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পাকিস্তানে ৫২১টি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি। এসব হামলায় ৮৫২ জন নিহত হয়, যার মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ছিলেন ৩৫৮ জন।

আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর থেকেই পাকিস্তান কয়েক মিলিয়ন আফগান শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। তবে, নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায়, বিশেষ করে শরণার্থীদের দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান সরকার।

গত নভেম্বর মাস থেকে প্রায় ১০ লক্ষ আফগান নাগরিককে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা এবং আফগান সরকার এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে শরণার্থীদের প্রতি মানবিক আচরণ করার আহ্বান জানিয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে গেলেও, ইসহাকদারের কাবুল সফর দুই দেশের মধ্যে পুনরায় আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তারা বলছেন, পাকিস্তানের জন্য নিরাপত্তা এবং কাবুলের জন্য বাণিজ্য—উভয় বিষয়ই একে অপরের সঙ্গে জড়িত।

তাই, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করতে একটি সমন্বিত পদ্ধতির প্রয়োজন।

আফগানিস্তানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শরণার্থীদের বিতাড়িত করার ঘটনায় তারা অসন্তুষ্ট। ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুত্তাকি, দার-এর সঙ্গে বৈঠকে জোরপূর্বক প্রত্যাবাসন বন্ধের আহ্বান জানান এবং পাকিস্তানে বসবাস করা আফগান নাগরিকদের অধিকার রক্ষার দাবি জানান।

অন্যদিকে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিরাপত্তা এবং সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিয়েছে। তাদের মতে, আঞ্চলিক বাণিজ্য ও যোগাযোগের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে, নিরাপত্তা বিষয়ক বিষয়গুলোর সমাধান করা জরুরি।

বিশ্লেষকদের মতে, নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটিই একমাত্র বিষয় হওয়া উচিত নয়।

দুই দেশের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং টেকসই সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বাড়ানোরও প্রয়োজন রয়েছে।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *