আন্দিজ ভালুকের প্রেম-ভাষা: বিজ্ঞানীরা শুনলেন তাদের মিলনের শব্দ
দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালায় বসবাসকারী, চশমা পরিহিত ভালুক (বৈজ্ঞানিক নাম: *Tremarctos ornatus*) – যাদের আগে নীরব হিসেবেই ধরা হতো, তাদের সম্পর্কে সম্প্রতি এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে এসেছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই ভালুক প্রজাতিটি আসলে মিলনের সময় বেশ শব্দ করে থাকে।
গবেষণায় ধরা পড়েছে, এই ভালুকেরা তাদের সঙ্গীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার সময় বিভিন্ন ধরনের শব্দ করে, যা আগে অজানা ছিল।
আন্দিজ অঞ্চলে ক্যামেরা ট্র্যাপ বসিয়ে ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে গবেষকরা এই ভালুকদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন। কলম্বিয়া এবং বলিভিয়ার গভীর অরণ্যে পাতা ফাঁদে ধরা পরে তাদের নানান মুহূর্ত।
ক্যামেরাবন্দী সেই ছবি ও শব্দ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা ভালুকদের শব্দভাণ্ডার সম্পর্কে নতুন তথ্য পান। আগে ধারণা ছিল, এই ভালুকেরা তেমন কোনো শব্দ করে না।
কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, তারা বিভিন্ন সময়ে “হুম”, “গর্রর” শব্দ করে এবং “কামড়”-এর মতো তীক্ষ্ণ শব্দও করে থাকে।
আলেকজান্ডার ভন হামবোল্ট ইনস্টিটিউট ফর বায়োলজিক্যাল রিসোর্সেস রিসার্চের সহযোগী গবেষক অ্যাঞ্জেলা মেনডোজা-হেনাও জানান, “আগেকার ধারণা ছিল এই প্রাণীগুলো নীরব। কিন্তু আমরা দেখেছি, তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নানা ধরনের শব্দ করে চলেছে।
গবেষণায় জানা গেছে, ভালুকেরা মিলনের সময় প্রধানত পাঁচটি ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করে।
এর মধ্যে “কামড়” শব্দটি স্ত্রী ভালুকের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে শোনা যায়, যা পুরুষ সঙ্গীর ঘাড়ে কামড়ানোর প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হয়।
হামবোল্ট ইনস্টিটিউটের সংগ্রহশালার কিউরেটর নিকোলাস রেয়েস-আমায়া ব্যাখ্যা করেন, “পুরুষ সঙ্গীর কামড়ে স্ত্রী ভালুক উত্তেজিত হয় এবং মিলন আরও তীব্র হয়।
এই ধরনের শব্দ এর আগে কোনো ভালুক প্রজাতিতে শোনা যায়নি। নীরব হিসেবে পরিচিত আন্দিজ ভালুকের ক্ষেত্রে এই আবিষ্কার সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, শব্দগুলো ভালুকদের মিলনের চূড়ান্ত মুহূর্তের ইঙ্গিত বহন করে।
এই আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বিজ্ঞানী অ্যাড্রিয়ানা রেয়েস। তিনি ক্যামেরায় ধারণ করা অসংখ্য ঘণ্টার শব্দ বিশ্লেষণ করে স্পেকট্রোগ্রাম তৈরি করেন।
তার কাজটি এই গবেষণার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বর্তমানে তিনি প্রয়াত।
গবেষকরা জানিয়েছেন, ক্যামেরা ট্র্যাপে ধারণ করা প্রত্যেকটি মিলনের প্রক্রিয়া অন্তত এক ঘণ্টা স্থায়ী হয়।
মেনডোজা-হেনাও বলেন, “তারা পুরো সময় জুড়েই শব্দ করতে থাকে। এগুলো কোনো আকস্মিক শব্দ নয়।
আন্দিজ ভালুকেরা তাদের লুকিয়ে থাকার ক্ষমতার জন্য পরিচিত।
রেয়েস-আমায়া বলেন, “তারা যখন চায়, তখন নিজেদের লুকিয়ে রাখতে পারে।
ভালুকেরা গাছের উঁচু ডালে লুকিয়ে থাকতেও পারদর্শী।
গবেষকরা এখনো এর কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।
এই গবেষণা কেবল আন্দিজ ভালুকের শব্দভাণ্ডার সম্পর্কে নতুন তথ্য দেয়নি, বরং অন্যান্য ভালুক প্রজাতিদের যোগাযোগের ধরন সম্পর্কেও ধারণা দিয়েছে।
মেরু ভালুকেরা তেমন কোনো শব্দ করে না।
অন্যদিকে, কালো ভালুকেরা সাধারণত বাদামি ভালুকের চেয়ে বেশি শব্দ করে, কারণ তারা ঘন জঙ্গলে বাস করে, যেখানে দেখা কঠিন।
তাই তাদের একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য শব্দ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
এমনকি পান্ডারাও, যারা বন্দী অবস্থায় অন্তত ১১ ধরনের শব্দ করে, মিলনকালে আরও বেশি শব্দ করে থাকে।
এই গবেষণা ভবিষ্যতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং তাদের আচরণ আরও ভালোভাবে বুঝতে সহায়ক হবে।
আমাদের দেশের বন্যপ্রাণীদের ক্ষেত্রেও এই ধরনের গবেষণা অত্যন্ত জরুরি, যা তাদের সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করতে পারে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক