প্রাচীন আবর্জনাই কি উপকূল বাঁচাচ্ছে?

প্রাচীন মানুষের ফেলে যাওয়া আবর্জনা কিভাবে উপকূল রক্ষা করছে: জর্জিয়া থেকে বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা?

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের উপকূলবর্তী দ্বীপগুলোতে কয়েক হাজার বছর আগের মানুষের ফেলে যাওয়া ঝিনুকের খোলস আজ দ্বীপগুলোকে রক্ষা করছে। গভীর বনের পাশে অবস্থিত এই দ্বীপগুলোতে এক সময়ের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ফেলে যাওয়া কোটি কোটি ঝিনুকের স্তূপ বর্তমানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে দ্বীপগুলোর ভাঙন রোধ করছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।

গবেষণা বলছে, আদিবাসী মানুষেরা একসময় এই দ্বীপগুলোতে বসবাস করত এবং ঝিনুক ছিল তাদের প্রধান খাদ্য। খাবার শেষে তারা এইসব ঝিনুকের খোলসগুলো দ্বীপের আশেপাশে ফেলত।

সময়ের সাথে সাথে এই খোলসগুলো স্তূপ আকারে জমতে থাকে এবং দ্বীপগুলোর ভূমিকে উঁচু করে তোলে। পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ববিদ জ্যাকব হল্যান্ড-লুউইজ এই বিষয়ে বলেন, “আমরা এখন যে পরিবেশ উপভোগ করি, তা হাজার হাজার বছর ধরে আদিবাসী মানুষের ব্যবস্থাপনার ফল।”

ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, জর্জিয়ার এই দ্বীপগুলো সম্ভবত প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার বছর আগে সমুদ্রের স্তর পরিবর্তন, স্রোত এবং বালু জমার ফলে গঠিত হয়েছিল। প্রায় ৫ হাজার বছর আগে, হোলোসিন যুগে সমুদ্রের স্তর স্থিতিশীল হওয়ার পরে আধুনিক দ্বীপগুলোর রূপ সৃষ্টি হয়।

প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা যায়, এখানকার আদিবাসী জনগোষ্ঠী, যারা মুসকোজি ক্রিক জাতির পূর্বপুরুষ, দ্বীপগুলো গঠিত হওয়ার পরেই এখানে বসবাস শুরু করে। তারা সমুদ্র থেকে খাবার সংগ্রহ করত, যার মধ্যে ঝিনুক অন্যতম ছিল।

গবেষণায় দেখা গেছে, এই ঝিনুকের স্তূপগুলো দ্বীপগুলোর উচ্চতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

উদাহরণস্বরূপ, সাপেলো দ্বীপের প্রায় ১৬৩ একর জায়গা জুড়ে প্রায় ১.৬ বিলিয়ন ঝিনুকের খোলস রয়েছে। গবেষকরা দেখেছেন, যদি এই ঝিনুকের স্তরগুলো না থাকত, তাহলে দ্বীপগুলোর একটি বড় অংশ, বিশেষ করে প্যাটারসন দ্বীপের প্রায় ৫ শতাংশ, জোয়ারের সময় পানিতে তলিয়ে যেত।

এমনকি ঘূর্ণিঝড় ও বড় ধরনের ঝড়ের সময় ভূমি আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হত।

আশ্চর্যজনকভাবে, ১৮ শতকে নীল, তুলা ও ধানের বাগান তৈরি করার জন্য ক্রীতদাস শ্রমিকদের ব্যবহার করা হতো, যা আদিবাসী জনবসতির কাছাকাছি স্থাপন করা হয়েছিল। এর কারণ ছিল, ঝিনুকের খোলস মিশ্রিত মাটি ক্যালসিয়াম কার্বোনেট ও অন্যান্য পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ ছিল, যা জমির উর্বরতা বাড়াত।

এই অঞ্চলের গাল্লা-জিচি সম্প্রদায়ের মানুষেরাও ঝিনুকের খোলস সমৃদ্ধ ভূমিকে মূল্যবান মনে করত।

এই গবেষণাটি পরিবেশ সংরক্ষণের চিরাচরিত ধারণাকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে সাহায্য করে।

ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ববিদ জয়ুর মধুসূদন মেহতা বলেন, “এই গবেষণাটি অত্যন্ত মূল্যবান, কারণ এটি দেখায় কিভাবে মানুষের কার্যকলাপ পরিবেশের ক্ষতি না করে বরং কিছু ক্ষেত্রে উপকারও করতে পারে।”

বর্তমানে, ‘শেল টু শোর’ নামক একটি অলাভজনক সংস্থা রেস্টুরেন্ট থেকে ঝিনুকের খোলস সংগ্রহ করে উপকূলের কাছাকাছি পুনরায় জমা করছে।

তারা ইতোমধ্যে আড়াই লক্ষ পাউন্ড ঝিনুকের খোলস সংগ্রহ করেছে এবং সাপেলো দ্বীপের সমুদ্র উপকূলকে শক্তিশালী করার জন্য সেগুলোকে সেখানে ফেলার অনুমতি চাইছে। শেল টু শোরের সহ-প্রতিষ্ঠাতা টাইলর লেসলি জানান, প্রাচীনকালে মানুষ যে ঝিনুক খেত এবং তাদের খোলস ফেলত, সেই ইতিহাসের সাথে তারা এক ধরনের সংযোগ অনুভব করেন।

এই গবেষণার ফলস্বরূপ, উপকূল রক্ষার জন্য নতুন প্রকল্প তৈরি করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় সামনে আসে।

বাংলাদেশের মতো দেশ, যেখানে উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাড়ছে, সেখানে এই ধরনের গবেষণা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষজনও জানে কিভাবে প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান করে পরিবেশকে টিকিয়ে রাখতে হয়।

সুন্দরবনের মানুষ যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। হয়তো, প্রাচীন মানুষেরা যেমন অজান্তে দ্বীপগুলোকে রক্ষা করেছে, তেমনি আমাদের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান ও চর্চা উপকূলীয় অঞ্চলের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *