ভিয়েতনাম যুদ্ধ: টেলিভিশনের পর্দায় যুদ্ধের বিভীষিকা!

**ভিয়েতনামের যুদ্ধের প্রতিচ্ছবি: কীভাবে এই সংঘাত আমেরিকান টেলিভিশনকে প্রভাবিত করেছে**

ষাটের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুধু একটি সামরিক সংঘাত ছিল না, বরং এটি ছিল একটি গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক আলোড়ন। এই যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যা তাদের সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে অনুভূত হয়েছিল।

টেলিভিশন, যা সেই সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী গণমাধ্যম ছিল, এই যুদ্ধের প্রতিফলন ঘটাতে শুরু করে। যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব থেকে শুরু করে এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়াগুলো—সবকিছুই উঠে এসেছে আমেরিকান টেলিভিশনের পর্দায়।

যুদ্ধের প্রাথমিক বছরগুলোতে, টেলিভিশন নেটওয়ার্কগুলো বিতর্কিত বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতে চাইত। মূলধারার অনুষ্ঠানগুলোতে যুদ্ধের সরাসরি উল্লেখ খুব কমই দেখা যেত, কারণ তারা বৃহত্তর দর্শকগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতে চেয়েছিল।

তবে, সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের স্মৃতিগুলো ধীরে ধীরে টেলিভিশনে জায়গা করে নিতে শুরু করে।

“গোমার পাইল, ইউ.এস.এম.সি.” (Gomer Pyle, U.S.M.C.) ছিল ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি জনপ্রিয় কমেডি ধারাবাহিক। যদিও সরাসরি যুদ্ধ নিয়ে এর কোনো গল্প ছিল না, তবে এর প্রেক্ষাপট ছিল মার্কিন মেরিন কোরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

এই ধারাবাহিকের মাধ্যমে দর্শক যুদ্ধের কাছাকাছি আসা সৈন্যদের জীবন সম্পর্কে জানতে পারতো।

“অল ইন দ্য ফ্যামিলি” (All in the Family) ছিল ১৯৭০-এর দশকের একটি উল্লেখযোগ্য ধারাবাহিক, যা যুদ্ধের বিষয়টিকে সরাসরি তুলে ধরেছিল। এই ধারাবাহিকে রক্ষণশীল পরিবারের কর্তা আর্চি বাংকারের সঙ্গে তার উদারপন্থী জামাতা মাইকেল “মিটহেড” স্টিভিকের রাজনৈতিক মতবিরোধ বিশেষভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

১৯৭৬ সালের একটি পর্বে, মাইকেলের এক বন্ধু, যে খসড়া এড়াতে পালিয়ে ছিল, ক্রিসমাসের রাতের ভোজে আসে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিবারে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়, যা যুদ্ধের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক বছর পর, “এম*এ*এস*এইচ” (M*A*S*H) ধারাবাহিকটি কোরিয়ান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত হলেও, ভিয়েতনামের যুদ্ধের মানসিকতাকে তুলে ধরেছিল। হাস্যরস এবং গভীর মানবিকতার মিশেলে তৈরি এই ধারাবাহিকটি যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং সৈন্যদের মানসিক কষ্টের চিত্র ফুটিয়ে তোলে।

১৯৮০-এর দশকে, “এ-টিম” (The A-Team) এর মতো অ্যাকশনধর্মী ধারাবাহিকগুলোতে ভিয়েতনামের অভিজ্ঞ যোদ্ধাদের সাহসী চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হতো। যদিও এটি ছিল কল্পনানির্ভর, তবুও এই ধারাবাহিকগুলো যুদ্ধের পরবর্তী সময়ের মানসিক আঘাত এবং সমাজে তাদের স্থান নিয়ে আসা সমস্যাগুলো তুলে ধরেছিল।

“টুর্ অফ ডিউটি” (Tour of Duty) ছিল ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে প্রচারিত একটি ধারাবাহিক, যা সরাসরি ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছিল। এটি যুদ্ধের ভয়াবহতা, সৈন্যদের ত্যাগ এবং যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক প্রভাবগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছিল।

এছাড়াও, “দ্য ওয়ান্ডার ইয়ার্স” (The Wonder Years) এবং “চাইনা বিচ”-এর মতো ধারাবাহিকগুলোতে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং সমাজের ওপর এর প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, “দিস ইজ আস” (This Is Us) এবং কেন বার্নস-এর প্রামাণ্যচিত্র “দ্য ভিয়েতনাম ওয়ার”-এর মতো অনুষ্ঠানে ভিয়েতনাম যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গভীর আলোচনা হয়েছে।

“দ্যা সিম্প্যাথাইজার” (The Sympathizer) নামক একটি নতুন ধারাবাহিক, যা ২০২৩ সালে মুক্তি পেয়েছে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষ এবং এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহকে ভিয়েতনামের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানোর চেষ্টা করেছে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ আমেরিকান টেলিভিশনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই যুদ্ধ শুধু একটি সামরিক সংঘাত ছিল না, এটি ছিল একটি অভিজ্ঞতা, যা আমেরিকান সমাজে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল।

টেলিভিশনের মাধ্যমে, এই যুদ্ধের গল্পগুলো দর্শক-অনুরাগীদের কাছে পৌঁছেছে, যা যুদ্ধের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে এবং বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করেছে। এই ধারাবাহিকগুলো যুদ্ধের মানবিক দিক, সমাজের বিভাজন এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবগুলো তুলে ধরেছে, যা আজও প্রাসঙ্গিক।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *