যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ প্রশমনের লক্ষ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেওয়া পদক্ষেপকে সন্দেহের চোখে দেখছে চীন। শুল্ক কমানোর ইঙ্গিত দিলেও, বেইজিং মনে করছে, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ আসলে অভ্যন্তরীণ চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা। চীন সরকারের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি চীনের ওপর আরোপিত বিশাল শুল্ক উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। এর মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু চীনের অভ্যন্তরে এই পদক্ষেপকে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, ট্রাম্প সম্ভবত কোণঠাসা হয়ে এমনটা করছেন। সামাজিক মাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছে এবং ট্রাম্পকে ‘পালিয়েছে’ বলেও অনেকে মন্তব্য করেছেন।
মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প জানান, চীনের পণ্যের ওপর আরোপিত অতিরিক্ত শুল্ক কমানো হবে। তিনি আলোচনার টেবিলে ‘নরম’ থাকার প্রতিশ্রুতি দেন এবং কোভিড-১৯ মহামারীর উৎস নিয়েও কোনো কথা বলবেন না বলে জানান।
তবে ট্রাম্পের এই শান্তি প্রস্তাব বেইজিংয়ের কাছ থেকে তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। বুধবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র জানান, চীন আলোচনার জন্য প্রস্তুত, তবে তারা কোনো চাপ বা হুমকির মুখে আলোচনা করবে না।
বেইজিংয়ের রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের পরিচালক ওয়াং ইওয়েইয়ের মতে, কয়েক সপ্তাহ ধরে পরস্পরবিরোধী বার্তা পাঠানোর পর চীনা কর্মকর্তারা ট্রাম্পকে বিশ্বাস করেন না। তিনি সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “বর্তমানে অভ্যন্তরীণ চাপ বাড়ছে এবং ট্রাম্পের বর্তমান বার্তাগুলো মূলত অভ্যন্তরীণ উদ্বেগকে প্রশমিত করার জন্য দেওয়া হচ্ছে। শেয়ারবাজারে দরপতন এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ে তিনি কিছুটা অস্থির হয়ে পড়েছেন। চীন তার শুল্ক কমানোর বিষয়ে ট্রাম্পের কথায় বিশ্বাস করে না। তিনি আজ এক কথা বলেন, তো কাল আরেক কথা।”
অন্যদিকে, গত কয়েক মাস ধরে চীন নিজেদের শক্ত অবস্থান দেখাচ্ছে। গত সপ্তাহে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তিনটি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশ সফর করেন এবং অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে চীনের অবস্থানকে সুসংহত করেন। তবে চীনের অর্থনীতি আগের মতো শক্তিশালী নয় এবং অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, শেষ পর্যন্ত বেইজিংকে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে।
ট্রাম্পের এই সম্ভাব্য অবস্থান পরিবর্তনের কারণ হলো, মার্কিন খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট, টার্গেট, হোম ডিপো এবং লোয়েস-এর প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে তার একটি ব্যক্তিগত বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে তারা শুল্ক নীতির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক প্রভাব এবং বাজারের অনিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
অনেক বড় বিনিয়োগ ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, বিশাল শুল্ক এবং চীনের পাল্টা প্রতিশোধমূলক শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে পারে।
বুধবার ট্রাম্প সাংবাদিকদের জানান, বাণিজ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কর্মকর্তাদের মধ্যে নিয়মিত আলোচনা চলছে। তবে তিনি বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি।
হোয়াইট হাউসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চীনের ওপর বর্তমানে যে ১৪৫ শতাংশ শুল্ক রয়েছে, তা কমিয়ে “প্রায় ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ” করা হতে পারে।
তবে ওয়াশিংটনে অবস্থানরত রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়াং ইওয়েইয়ের মতে, এই পরিমাণ শুল্ক কমালেও চীন আলোচনায় বসতে রাজি হবে না। তিনি বলেন, “যদি সত্যিই চীনের সঙ্গে আলোচনা করতে চান, তাহলে প্রথমে ভিত্তিহীন সব শুল্ক বাতিল করতে হবে।” তিনি আরও যোগ করেন, ট্রাম্প আসলে বেইজিংকে আলোচনার ফাঁদে ফেলতে চাইছেন।
চীনের অভ্যন্তরে অনেকেই মনে করেন, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ দুর্বলতা প্রদর্শনের শামিল। অনেক চীনা নাগরিক সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, তারা এই ধরনের কোনো আলোচনার সঙ্গে একমত নন।
তবে চীনের কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য যুদ্ধ দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চীনা পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ সিএনএনকে জানান, অতিরিক্ত শুল্কের কারণে চীনের অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব পড়ছে। তাদের মতে, এই শুল্ক বহাল থাকলে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে মারাত্মক প্রভাব পড়বে, যার ফলে ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে এবং সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে।
এপ্রিলের শুরুতে, চীনের শীর্ষস্থানীয় একটি গবেষণা সংস্থা, চায়না একাডেমি অফ সোশ্যাল সায়েন্সেসের একজন গবেষক, তাঁর ব্যক্তিগত উইচ্যাট অ্যাকাউন্টে চীনের পাল্টা পদক্ষেপকে ‘সম্পূর্ণ ভুল’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি লেখেন, “যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক বৃদ্ধি করে যেন নিজের পায়ে কুড়াল মারছে। আমাদেরও একই কাজ করা উচিত নয়।” যদিও এই পোস্টটি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেওয়ার পর সেন্সর করা হয়।
গত মাসে বেইজিং চলতি বছরে “প্রায় ৫ শতাংশ” প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে, যা তাদের রফতানি-নির্ভর অর্থনীতির প্রতি আত্মবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এই লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, গত মার্চে রফতানি ১২.৪ শতাংশ বাড়লেও, মার্কিন শুল্কের কারণে আগামী মাসগুলোতে এই ধারা বজায় রাখা কঠিন হবে। বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসও জানিয়েছে, মার্কিন শুল্ক চীনের অর্থনীতিতে “গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব” ফেলবে।
ওই বিশেষজ্ঞ আরও মনে করেন, চীন সময়মতো আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হবে। তিনি বলেন, “চীন আসলে কৌশল দেখাচ্ছে। তারা দুর্বলতা প্রকাশ করতে চাইছে না, বরং যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করছে।”
তথ্য সূত্র: সিএনএন