জম্মু ও কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ২৬, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কা।
জম্মু ও কাশ্মীরের একটি মনোরম স্থানে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নিহতদের মধ্যে পর্যটকদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও রয়েছেন।
এই ঘটনার পর ভারত সরকার তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে।
গত কয়েকদিন ধরেই কাশ্মীর উপত্যকায় পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত ছিল। পর্যটকদের আনাগোনাও বেড়েছিল, যা স্থানীয় অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক দিক ছিল।
কিন্তু এই হামলার ফলে সেই শান্তি ভেঙে গেছে এবং পুরো অঞ্চলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। হামলার পরপরই ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, “আমরা এর জবাব দেব।”
একটি স্বল্প পরিচিত সংগঠন ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (TRF) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে।
তবে ভারতের ধারণা, এই সংগঠনটি পাকিস্তানের মদদপুষ্ট এবং লস্কর-ই-তৈয়বা অথবা অন্য কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর হয়ে কাজ করে।
যদিও পাকিস্তান সরকার জঙ্গিদের মদদ দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছে, তবে তারা কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি সমর্থন জানায়।
এই হামলার জেরে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনা নতুন করে বেড়েছে। কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ হয়েছে এবং বহুবার তারা সংঘাতের কাছাকাছি পৌঁছেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক জানিয়েছেন, এই হামলার এক সপ্তাহ আগে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির কাশ্মীরকে পাকিস্তানের ‘জীবনরেখা’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন এবং কাশ্মীরিদের ‘বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে’ সমর্থন করার অঙ্গীকার করেছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ এবং দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক লেখক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, “এই মুহূর্তে পরিস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দুই দেশই পারমাণবিক শক্তিধর এবং একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে।”
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ভারত সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
- এর মধ্যে রয়েছে, পাকিস্তানের হাই কমিশনের প্রতিরক্ষা, নৌ ও বিমান উপদেষ্টাদের বহিষ্কার, একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত বাণিজ্য পথ বন্ধ করা এবং প্রথমবারের মতো সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত।
- সিন্ধু জল চুক্তি উভয় দেশের মধ্যেকার একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি, যা নদীর জল ব্যবহারের বিষয়ে দুই দেশের মধ্যেকার বিবাদ মেটায়।
- এই চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, যা দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্ককে আরও কঠিন করে তুলবে।
অন্যদিকে, হামলার তীব্র নিন্দা করে কাশ্মীরি সংগঠনগুলো দোকানপাট বন্ধ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বিক্ষোভ মিছিল করে “পর্যটকরা আমাদের জীবন” শ্লোগান দিয়েছে।
শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সিদ্দিক ওয়াহিদ বলেন, “কাশ্মীরিরা এই ঘটনায় সত্যিই ক্ষুব্ধ।”
১৯৮৯ সাল থেকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে অস্থিরতা চলছে। বহু মানুষ নিহত হয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সহিংসতা কিছুটা কমেছিল।
২০১৯ সালে ভারতীয় সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে রাজ্যটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করে।
এই সিদ্ধান্তের ফলে সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয় এবং পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ে। তবে অনেক স্থানীয় মানুষের মধ্যে এর বিরুদ্ধে ক্ষোভও রয়েছে।
আরেকজন ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই হামলা সরকারের ‘স্বাভাবিক’ অবস্থার ধারণাটিকে নস্যাৎ করে দিয়েছে।”
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সৌদি আরব সফর বাতিল করে দ্রুত দেশে ফেরা সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত বহন করে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারত সরকার সম্ভবত সীমান্ত পেরিয়ে হামলা চালাতে পারে, যেমনটা তারা ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর করেছিল।
তবে এবার নিহতরা সেনা বা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য না হওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
“পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ভারতকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিস্থিতি একবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে,” বলেছেন ওই নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
জম্মু ও কাশ্মীরে এই হামলার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর সময়।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে একজন উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি দল ভারত সফর করছেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের স্বামী ডগলাস এমহফ-এর ভারত সফরের সময় প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং ভারতকে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০০১ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় পার্লামেন্টে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ প্রায় শুরু হয়ে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র সে সময় পরিস্থিতি শান্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
কুগেলম্যানের মতে, “উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বার্তা থেকে বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পাশে আছে এবং ভারতের প্রতিক্রিয়ার পথে কোনো বাধা দেবে না।”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান