বিশ্বজুড়ে বিলুপ্তির পথে থাকা একটি প্রাণী, যা কিনা আঁশযুক্ত স্তন্যপায়ী হিসেবে পরিচিত, তার নাম হলো প্যাঙ্গোলিন। চোরাচালানের শিকার হওয়া এই নিরীহ প্রাণীটির জীবনযাত্রা নিয়ে নির্মিত হয়েছে একটি নতুন তথ্যচিত্র। অস্কারজয়ী পরিচালক এই ছবিটির মাধ্যমে প্যাঙ্গোলিনের গোপন জীবনযাত্রা উন্মোচন করেছেন।
“প্যাঙ্গোলিন: কুলুর যাত্রা” নামের এই তথ্যচিত্রটি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে।
প্যাঙ্গোলিন হলো বিশ্বের একমাত্র আঁশযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী। এদের প্রধান পরিচিতি হলো, এরা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়া বন্যপ্রাণীদের মধ্যে অন্যতম।
সাধারণত এদের শরীর আঁশ দ্বারা আবৃত থাকে। এই প্রাণীগুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা খুবই কম। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই পরিচালক পিপা এর্লিখ তৈরি করেছেন “প্যাঙ্গোলিন: কুলুর যাত্রা” তথ্যচিত্রটি।
এই ছবিতে একটি তিন মাস বয়সী ভূমি প্যাঙ্গোলিন ‘কুলু’-র গল্প তুলে ধরা হয়েছে, যাকে অবৈধ বন্যপ্রাণী বাণিজ্য থেকে উদ্ধার করা হয়। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকায় তাকে বন্য পরিবেশে ফিরিয়ে আনার জন্য একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া শুরু হয়।
পরিচালক এর্লিখ জানান, কুলুর নিজস্ব একটি ব্যক্তিত্ব আছে। সে খুবই জেদি এবং একরোখা। সে তার নিজের ইচ্ছামতো চলতে পছন্দ করে, এবং কোনো অচেনা দ্বি-পায়ী প্রাণীর অনুসরণ করাটা তার একদমই পছন্দ নয়।
কুলুকে উদ্ধারের কাজে জড়িত ছিলেন গ্যারেথ থমাস নামের একজন সংরক্ষণ কর্মী। প্যাঙ্গোলিনদের পুনর্বাসন একটি অত্যন্ত কঠিন প্রক্রিয়া।
বন্য পরিবেশে ফিরিয়ে দেওয়ার আগে তাদের প্রতিদিন হাঁটিয়ে খাবার খাওয়ানো হতো। কখনও কখনও তাদের দিনে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত হাঁটতে হতো, যাতে তারা পোকামাকড় ও উইপোকা খেতে পারে। বন্য পরিবেশে ফেরানোর আগে তাদের নতুন পরিবেশের শব্দ, গন্ধ এবং দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত করানো হতো, যা তাদের বন্দী জীবনের ট্রমা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করত।
গ্যারেথ থমাস এক সাক্ষাৎকারে জানান, কুলুকে বন্য পরিবেশে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তাকে ১৮ মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তথ্যচিত্রটি জোহানেসবার্গ থেকে চার ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত লাপালালা ওয়াইল্ডারনেস রিজার্ভের বন্য পরিবেশে কুলু এবং গ্যারেথের যাত্রা অনুসরণ করে।
পরিচালক এর মাধ্যমে দর্শকদের প্যাঙ্গোলিনের জগৎ সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
পিপা এর্লিখ আরও বলেন, “প্যাঙ্গোলিন দেখতে অনেকটা কল্পনাবাদী, তারা স্তন্যপায়ী হওয়া সত্ত্বেও আঁশ দিয়ে আবৃত থাকে। আমরা চাই না, প্যাঙ্গোলিনকে শুধু বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়া প্রাণী হিসেবে দেখা হোক।
আমরা চাই, সবাই তাদের আনন্দময়, অনন্য এবং বিশেষ প্রাণী হিসেবে দেখুক।
ভূমি প্যাঙ্গোলিন বা টেমিনক প্যাঙ্গোলিন আফ্রিকার চারটি প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এদের বিস্তৃতি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সুদান পর্যন্ত।
কুলু যখন জোহানেসবার্গ বন্যপ্রাণী ভেটেরিনারি হাসপাতালে আসে, তখন সেখানকার কর্মীরা তাকে ‘গিজমা’ নামে ডাকত, যার অর্থ জুলু ভাষায় ‘দৌড়ানো’। কারণ, দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী হলেও কুলু সবসময় পালানোর চেষ্টা করত।
পরবর্তীতে, গ্যারেথ থমাস কুলুকে ‘কুলু’ নামে ডাকতে শুরু করেন, যার অর্থ জুলু ভাষায় ‘সহজ’।গ্যারেথ ছোটবেলায় দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ের জঙ্গলে গ্রীষ্মকাল কাটিয়েছেন।
স্কুলের পর তিনি প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শহরে বেশি সময় কাটাতে শুরু করেন। ২০১৯ সালে বন্যপ্রাণী ফটোগ্রাফি শুরু করার পর, তিনি আফ্রিকান প্যাঙ্গোলিন ওয়ার্কিং গ্রুপ এবং জোহানেসবার্গ বন্যপ্রাণী ভেটেরিনারি হাসপাতালের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন।
প্যাঙ্গোলিন খুবই সংবেদনশীল প্রাণী হওয়ায়, তথ্যচিত্রের শুটিংয়ের সময় অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। গ্যারেথ থমাস-এর তোলা ছবিগুলো এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
পরিচালক এর্লিখ জানান, গ্যারেথের সঙ্গে এই প্রাণীদের গভীর সম্পর্ক ছিল, যা তথ্যচিত্রের জন্য প্রয়োজনীয় ঘনিষ্ঠ দৃশ্যগুলো পেতে সহায়তা করেছে।
প্যাঙ্গোলিন পাচারের প্রধান কারণ হলো, এদের আঁশ, মাংস এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ ঐতিহ্যবাহী ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। চামড়া ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন চামড়ার সামগ্রী তৈরিতে।
Traffic নামক একটি এনজিওর তথ্য অনুযায়ী, প্যাঙ্গোলিন পাচারের প্রধান গন্তব্য চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে এশিয়াতে চারটি প্রজাতির প্যাঙ্গোলিনের মধ্যে তিনটিই চরম বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।
২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে, এশিয়াতে পাচার হওয়া প্যাঙ্গোলিনের অর্ধেকের বেশি ছিল আফ্রিকার প্রজাতি। যার মধ্যে প্রায় ২৪৪,৬০০ কিলোগ্রাম আঁশ এবং ১০,৯৭১টি প্যাঙ্গোলিন ছিল।
আফ্রিকার প্যাঙ্গোলিন ওয়ার্কিং গ্রুপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রে জ্যানসেন এই পাচারের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ৩0১টি জীবিত প্যাঙ্গোলিনকে উদ্ধার করতে সাহায্য করেছেন, যার মধ্যে কুলুও ছিল।
এই সময়ে প্রায় ৭০০ পাচারকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ড. ক্যারিন লরেন্স, জোহানেসবার্গ বন্যপ্রাণী ভেটেরিনারি হাসপাতালের প্রধান পশুচিকিৎসক। তিনি জানান, উদ্ধার হওয়া প্যাঙ্গোলিনদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন খুবই কঠিন। কারণ, তারা পর্যাপ্ত খাবার না পাওয়ায় তাদের শরীরে প্রোটিনের অভাব দেখা দেয়।
এর ফলে ফুসফুসে জল জমে এবং অগ্ন্যাশয় কাজ করা বন্ধ করে দেয়, ফলে তারা খাবার হজম করতে পারে না।
বর্তমানে, লাপালালা ওয়াইল্ডারনেসে আফ্রিকান প্যাঙ্গোলিন ওয়ার্কিং গ্রুপ কর্তৃক পরিচালিত একটি ‘প্যাঙ্গোলারিয়াম’ খোলা হয়েছে, যা হাসপাতাল এবং পুনর্বাসন কেন্দ্রের মাঝামাঝি একটি আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে।
এখানে একাধিক প্যাঙ্গোলিনের থাকার ব্যবস্থা থাকলেও, তাদের প্রত্যেককে খাবার দেওয়ার জন্য একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রয়োজন।
প্যাঙ্গোলিন পাচার একটি গুরুতর সমস্যা, এবং এদের সংখ্যা বিশ্বজুড়ে হ্রাস পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা (আইইউসিএন) এর মতে, আটটি প্রজাতির প্যাঙ্গোলিনের সবগুলোই দুর্বল, বিপন্ন বা চরম বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।
পিপা এর্লিখ মনে করেন, প্যাঙ্গোলিন সত্যিই আমাদের চারপাশের প্রকৃতির দুর্বলতার প্রতীক। তিনি আশা করেন, দর্শকরা কুলুর গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হবে এবং তাদের আবাসস্থল রক্ষার জন্য এগিয়ে আসবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন