যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রভাবশালী বিনিয়োগকারী কেন গ্রিফিন। তিনি মনে করেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেওয়া বাণিজ্য যুদ্ধের সিদ্ধান্ত আমেরিকার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করছে এবং এর ফলে বিশ্ববাজারে মার্কিন অর্থনীতির ওপর আস্থা হারাচ্ছে বিনিয়োগকারীরা।
সিকিডেল নামক বৃহৎ হেজ ফান্ডের প্রধান নির্বাহী কেন গ্রিফিন সম্প্রতি সেমাফোর ওয়ার্ল্ড ইকোনমি সামিটে দেওয়া বক্তব্যে এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র শুধু একটি দেশ নয়, এটি একটি ব্র্যান্ডও বটে। সংস্কৃতি, আর্থিক শক্তি কিংবা সামরিক সক্ষমতা—সবকিছু মিলিয়ে এই ব্র্যান্ড বিশ্বজুড়ে একটি আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ছিল।”
কিন্তু আমরা এখন সেই ব্র্যান্ডের অবক্ষয় দেখছি।
গ্রিফিনের মতে, বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে বিনিয়োগকারীরা এখন যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষ করে মার্কিন ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করতে দ্বিধা বোধ করছেন। কারণ, ট্রাম্পের শুল্ক নীতির ফলে বিশ্ব বাজারে আমেরিকার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, “একজন ক্রেতা হিসেবে, আপনারা কোনো ব্র্যান্ডের পণ্য কেনেন কারণ আপনারা সেই ব্র্যান্ডের ওপর আস্থা রাখেন। আর্থিক বাজারে, মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের মতো শক্তিশালী ব্র্যান্ড আর নেই।
ডলারের দৃঢ়তা এবং ট্রেজারি বন্ডের নির্ভরযোগ্যতা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা সেই ব্র্যান্ডকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছি।”
ঐতিহাসিকভাবে, ট্রেজারি বন্ডকে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সংকটকালে বিনিয়োগকারীরা তাদের অর্থ ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ার বাজার থেকে সরিয়ে ট্রেজারি বন্ডের দিকে ঝুঁকতেন।
কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। বাণিজ্য যুদ্ধ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কা করছেন, এর ফলে শুধু বিশ্ব অর্থনীতি নয়, বরং আমেরিকার নিজস্ব অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সম্ভবত দেশটির সুনামেরও অপূরণীয় ক্ষতি হবে।
জেপি মরগান চেজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জেমি ডাইমনও একই ধরনের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, আমেরিকার বিশ্বব্যাপী “অসাধারণ অবস্থান” দেশটির অর্থনীতি, সামরিক শক্তি এবং নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছে।
কিন্তু শুল্ক এবং ট্রাম্পের “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতি যুক্তরাষ্ট্রের এই বিশেষ অবস্থানকে দুর্বল করে দিতে পারে। ডাইমনের ভাষায়, “আমেরিকা ফার্স্ট নীতি ভালো, যদি এটি ‘আমেরিকা একাই’ তে পরিণত না হয়।
পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক ও অর্থনৈতিক জোটগুলো যদি ভেঙে যায়, তবে সময়ের সাথে সাথে আমেরিকার দুর্বল হয়ে পড়া অনিবার্য।”
কেন গ্রিফিন আমেরিকার ব্র্যান্ডকে একটি বিখ্যাত পোশাক প্রস্তুতকারক, একটি ভালো হ্যান্ডব্যাগ অথবা নির্ভরযোগ্য গাড়ির প্রস্তুতকারকের সঙ্গে তুলনা করেন।
তিনি বলেন, যদি এই ব্র্যান্ডগুলোর কোনো একটির সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়, তবে সেই ক্ষতি পূরণ করা কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি বলেন, “কম দামে নামবিহীন পোশাক পাওয়া যায়, তবে আপনি সেই পোশাকটিই চান, যা সহজে নষ্ট হবে না।
একটি ব্র্যান্ডের সম্মান পুনরুদ্ধারে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে।”
এই পরিস্থিতিতে, বিনিয়োগকারীরা এখন মার্কিন সম্পদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ডলারের দাম গত তিন বছরে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মন্দা নিয়ে উদ্বেগের কারণে মার্কিন ক্রুড অয়েলের দামও কমেছে। ট্রেজারি বন্ডের ফলন বাড়ছে, যা দামের বিপরীত দিকে যায়।
এসঅ্যান্ডপি ডাউ জোনস ইনডেক্স অনুযায়ী, শেয়ার বাজারের শীর্ষে থাকা সময় থেকে, প্রায় ৭ ট্রিলিয়ন ডলার বাজার মূলধন হারিয়েছে মার্কিন শেয়ার বাজার। (বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৭০০ লক্ষ কোটি টাকার সমান)।
কেন গ্রিফিন মনে করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তাঁর উপদেষ্টাদের এখন এই বাণিজ্য যুদ্ধের ভুলগুলো শুধরানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
তিনি বলেন, “যখন আপনার একটি ব্র্যান্ড থাকে, তখন সেই ব্র্যান্ডের সম্মান বজায় রাখতে হবে, যা এর শক্তি বাড়ায়। কারণ, একবার যদি আপনি সেই ব্র্যান্ডের ক্ষতি করেন, তবে সেই ক্ষতি পূরণ করতে হয়তো সারা জীবন লেগে যেতে পারে।”
তথ্য সূত্র: সিএনএন