মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের ধস নামতে শুরু করেছে। দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী কমে যাওয়া, আর্থিক সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা – সব মিলিয়ে এক কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এমনটাই উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘আল জাজিরা’য় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত কয়েক বছর ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা কমছে। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান খরচ, কোভিড-১৯ অতিমারী এবং অন্যান্য কিছু প্রবণতা।
বর্তমানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাই থেকে শুরু করে বিভাগ বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট সোনার মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাজেট ঘাটতির কারণে ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, সোনার স্টেট ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা প্রায় ২৪ মিলিয়ন ডলারের বাজেট ঘাটতির সম্মুখীন। এই কারণে তারা ২২টির বেশি বিভাগ এবং ১০০ জনের বেশি শিক্ষক পদ বাতিল করার পরিকল্পনা করছে। জানা গেছে, এর মধ্যে আর্ট হিস্টরি, অর্থনীতি, ভূতত্ত্ব, দর্শন, থিয়েটার ও নৃত্য এবং নারী ও জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের মতো বিষয়গুলো রয়েছে।
অন্যদিকে, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটিতেও একই ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। ২০২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি ৪৫ মিলিয়ন ডলারের বাজেট ঘাটতির শিকার হয়। এর ফলস্বরূপ, তারা তাদের কারিকুলাম থেকে ৩২টি বিষয় এবং প্রায় ১৪৩ জন শিক্ষককে ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, এই ধরনের ঘটনা এখন একটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেনসিলভেনিয়ার ক্লারিওন ইউনিভার্সিটি, ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি, নিউইয়র্কের কলেজ অব সেন্ট রোজ এবং ইউটাহর ইন্ডিপেন্ডেন্স ইউনিভার্সিটির মতো আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয় বন্ধ হয়ে গেছে, নয়তো অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে বাজেট ঘাটতি এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ সালে যেখানে ১ কোটি ৮০ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত, সেখানে ২০২১ সালে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ৫৪ লক্ষে। কোভিড-১৯ মহামারীর প্রথম বছরেই প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ শিক্ষার্থী কমে যায়। যদিও ২০২৩ সালে ভর্তির সংখ্যা সামান্য বেড়েছে, তবু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।
ফিনান্সিয়াল স্ট্রেস টেস্ট মডেলের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষের শেষ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৮০টি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর মূল কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়াকে চিহ্নিত করেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার এই সংকট আরও গভীর হওয়ার পেছনে বেশ কিছু রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বিদেশি শিক্ষার্থীদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে চীন থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও কমতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা কিছু সমস্যাও এই সংকটের জন্য দায়ী।
স্থায়ী অধ্যাপক নিয়োগের পরিবর্তে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ এবং লাভজনক ব্যবসার মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা ইত্যাদি বিষয়গুলো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
উচ্চশিক্ষার এই সংকট মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে, অনেক শিক্ষার্থী তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সমস্যা অনুভব করছেন। বিশেষ করে, শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাইরের শিক্ষার্থীরা এই সমস্যার শিকার হচ্ছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থার এই সংকট বাংলাদেশের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার এই ধরনের পরিবর্তন বিশ্বজুড়ে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে। আমাদের দেশেও উচ্চশিক্ষার গুণগত মান, খরচ এবং রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা