প্রাচীন সভ্যতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত: ইরাকের বুকে লুকানো এরিদু শহরের আবিষ্কার।
ইরাকের মরুভূমির গভীরে, হাজার বছর ধরে মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল এক প্রাচীন শহর। এই শহরের নাম এরিদু, যা পৃথিবীর বুকে মানব সভ্যতার উন্মেষের এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে এই শহরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করা হয়েছে, যা আমাদের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
১৯ শতকে, ব্রিটিশ কর্মকর্তা জন জর্জ টেইলর সর্বপ্রথম এই অঞ্চলের মাটি খুঁড়ে কিছু প্রাচীন নিদর্শনের সন্ধান পান। ১৮৫৪ সালে তিনি বাগদাদের ব্রিটিশ কনসাল জেনারেলের নির্দেশে এখানে খনন কাজ শুরু করেন। যদিও শুরুতে তিনি তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু খুঁজে পাননি, তবে তাঁর অনুসন্ধিৎসা পরবর্তী গবেষকদের জন্য এক নতুন দ্বার খুলে দেয়।
টেইলরের সেই প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া কিছু দেওয়াল, পাথরের প্ল্যাটফর্ম এবং মোজাইক কোণ দিয়ে সজ্জিত চুনাপাথরের স্তম্ভের ধ্বংসাবশেষই ছিল এরিদু শহরের প্রথম আভাস।
পরবর্তীকালে, এরিদু শহর সুমেরীয় সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। সুমেরীয় সভ্যতা ছিল বিশ্বের প্রাচীনতম পরিচিত সভ্যতাগুলির মধ্যে অন্যতম, যা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে দ্বিতীয় সহস্রাব্দ পর্যন্ত বর্তমান ইরাকে বিস্তার লাভ করে। সুমেরীয়রা তাদের জ্ঞান, শিল্পকলা এবং উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনার জন্য পরিচিত ছিল।
এরিদু শহর ছিল তাদের সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু, যা আধুনিক বিশ্বের অনেক কিছুই গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে।
সুমেরীয় রাজা তালিকা অনুসারে, এরিদু ছিল সেই শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম যেখানে “স্বর্গ থেকে রাজত্ব নেমে এসেছিল”। এটি ছিল “বন্যার” আগের রাজকীয় শহরগুলোর একটি। এই শহরের কেন্দ্রে ছিল Enki-র মন্দির, যা জল ও জ্ঞানের দেবতা হিসেবে সুমেরীয়দের কাছে পূজিত হতেন।
এই মন্দিরটি ছিল মেসোপটেমিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে আসা তীর্থযাত্রীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
প্রথম দিকে টেইলরের আবিষ্কার তেমন গুরুত্ব না পেলেও, পরবর্তীতে গবেষকদের আগ্রহ বাড়ে। ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ জাদুঘরের কর্মকর্তারা প্রত্নতত্ত্ববিদ রেজিনাল্ড ক্যাম্পবেল থম্পসনকে এখানে খনন করার জন্য পাঠান। এর কয়েক বছর পর, ব্রিটিশ মিশরবিদ হ্যারি আর.এইচ. হল এই শহরের গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন।
তবে, এরিদু শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খনন কাজ শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ১৯৪৬ সালে। ইরাক স্বাধীনতা লাভের পর, তাদের জাতীয় ঐতিহ্য তুলে ধরার জন্য প্রত্নতাত্ত্বিক প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়।
ইরাকি প্রত্নতত্ত্ববিদ ফুয়াদ সফার এবং ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ সেটন লয়েডের নেতৃত্বে এখানে ব্যাপক খনন কাজ শুরু হয়। তাঁরা মাটির গভীরে প্রাচীন সভ্যতার আরও অনেক নিদর্শন খুঁজে পান।
খননকালে, তাঁরা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের শেষের দিকে নির্মিত একটি অসমাপ্ত জিগগুরাত বা স্তূপাকার পিরামিডের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। এর নিচে পাওয়া যায় উরুক যুগের (খ্রিস্টপূর্ব ৪,৫০০-৩,২০০ অব্দ) এবং প্রাক-সুমেরীয় উবাইদ যুগের (খ্রিস্টপূর্ব ৫,৩০০-৩,৮০০ অব্দ) বিভিন্ন নিদর্শন।
খননকারীরা Enki-র মন্দিরের একাধিক সংস্করণ খুঁজে পান, যা দুই হাজার বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে নির্মিত হয়েছিল। ইতালীয় মেসোপটেমীয় ইতিহাসবিদ মারিও লিভেরানির মতে, এই মন্দিরগুলো বারবার সংস্কার করা হয়েছিল এবং প্রতিটি ধ্বংসাবশেষের উপরে নতুন মন্দির তৈরি করা হয়েছিল।
সময়ের সাথে সাথে এই মন্দিরগুলো আরও বড় হতে থাকে, যা বিশেষ স্থানগুলোতে উপাসনার দিকে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
বর্তমানে, এরিদুর আবিষ্কার আমাদের প্রাচীন ইতিহাস এবং সভ্যতার বিবর্তন সম্পর্কে নতুন ধারণা দেয়। এর থেকে আমরা জানতে পারি কিভাবে মানুষ ধীরে ধীরে উন্নত জীবনযাত্রার দিকে এগিয়ে গেছে।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, এই শহরের আরও অনেক অজানা রহস্য এখনো উন্মোচন করা বাকি আছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও, ইতালীয় এবং ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদগণ এখানে পুনরায় খনন কাজ শুরু করার পরিকল্পনা করছেন, যা মানব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় উন্মোচন করতে সহায়ক হবে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক