জাপানের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো সেখানকার হস্তশিল্প। কিন্তু আধুনিক জীবনযাত্রা, নগরায়ণ এবং জনসংখ্যা হ্রাসের কারণে এই শিল্পগুলো আজ হুমকির সম্মুখীন। কারুশিল্পীরা তাঁদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সংগ্রাম করছেন।
তবে এই সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে এসেছে পর্যটন। বর্তমানে, জাপানে এমন কিছু হোটেল তৈরি হয়েছে, যেখানে পর্যটকদের জন্য স্থানীয় কারুশিল্প বিষয়ক অভিজ্ঞতা অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন পর্যটকদের জন্য এক বিশেষ অভিজ্ঞতা তৈরি হচ্ছে, তেমনই স্থানীয় কারুশিল্পীদের জীবিকা নির্বাহের পথও সুগম হচ্ছে।
পরিসংখ্যান বলছে, জাপানে ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পের বিক্রি ১৯৭৫ সালে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এরপর থেকে তা ক্রমাগত কমতে শুরু করে, যা বর্তমানে সেই সময়ের তুলনায় এক-পঞ্চমাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে, কারুশিল্পীর সংখ্যাও এক তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে।
তোয়ামা প্রিফেকচারের ইনামি শহরের কথা ধরুন, যেখানে প্রায় ৮,০০০ মানুষের মধ্যে প্রায় ১৫০ জন কাঠের কাজ করেন। সেখানকার ‘বেড অ্যান্ড ক্রাফট’ নামের একটি হোটেল পর্যটকদের জন্য স্থানীয় কারুশিল্পীদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে।
এই হোটেলে আসা অতিথিরা স্থানীয় কারুশিল্পের সঙ্গে হাতে-কলমে কাজ করার সুযোগ পান, যা তাঁদের এক ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা দেয়। এর ফলে কারুশিল্পীরা যেমন তাঁদের কাজের জন্য পারিশ্রমিক পান, তেমনই তাঁদের শিল্পকর্মের প্রচারও হয়। এই হোটেলের ছয়টি ভিলা স্থানীয় শিল্পীদের কাজের গ্যালারি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়, যেখানে রাতের ভাড়ার একটি অংশ শিল্পীরা পান।
ফুকুওকা প্রিফেকচারের ইয়ামে অঞ্চলে ‘ক্রাফট ইন তে’ নামের একটি হোটেলও একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই অঞ্চলের ‘কুরুমে কাসুরি’ (জাপানি ইকাত টেক্সটাইল) সহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী শিল্পের প্রসারে তারা কাজ করছে।
জানা যায়, ১৯৩০-এর দশকে এখানে প্রায় ১,৫০০টি কর্মশালা ছিল, যেখানে কুরুমে কাসুরি তৈরি হতো। বর্তমানে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২০টিতে। এই পরিস্থিতিতে, ‘ক্রাফট ইন তে’ পর্যটকদের কারুশিল্প বিষয়ক অভিজ্ঞতা প্রদান করে এবং আয়ের একটি বড় অংশ সরাসরি কারুশিল্পীদের হাতে পৌঁছে দেয়।
এর মাধ্যমে একদিকে যেমন তাঁদের আয়ের একটি নতুন উৎস তৈরি হচ্ছে, তেমনই তাঁদের শিল্পকর্ম বহির্বিশ্বে পরিচিতি লাভ করছে।
জাপানের এই উদ্যোগগুলি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে খুবই প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্প যেমন- জামদানি, নকশিকাঁথা, মাটির তৈরি জিনিস—এগুলোও নানা সংকটের সম্মুখীন। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এসব শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
পর্যটকদের অংশগ্রহণে আমাদের দেশের কারুশিল্পগুলিকেও বাঁচানো সম্ভব। স্থানীয় কারুশিল্প বিষয়ক অভিজ্ঞতা তৈরি করতে পারলে, তা একদিকে যেমন পর্যটকদের আকর্ষণ করবে, তেমনই কারুশিল্পীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়ক হবে।
জাপানের অন্যান্য কয়েকটি হোটেল ও প্রতিষ্ঠানের কথা নিচে উল্লেখ করা হলো:
- **তানিয়া (TANIYA), গিফু প্রিফেকচার:** তাকায়ামার সংকীর্ণ রাস্তাগুলোতে অবস্থিত একটি পুরনো কাঠের তৈরি বাড়িতে এই হোটেলটি অবস্থিত। এখানে আগত অতিথিদের জন্য স্থানীয় কারুশিল্প বিষয়ক বিভিন্ন কার্যক্রমের ব্যবস্থা করা হয়।
- **তাকিগাহারা (TAKIGAHARA), ইশিকাওয়া প্রিফেকচার:** এই কমিউনিটিতে একটি খামার, কর্মশালা, প্রকৃতি বিদ্যালয় এবং সঙ্গীত উৎসবের আয়োজন করা হয়। এখানে পর্যটকদের জন্য ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প বিষয়ক বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, যেমন—কাগজ তৈরি ও সোনার পাতা ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
- **সাতোয়ামা জুজো (Satoyama Jujo), নিigata প্রিফেকচার:** এই হোটেলে আসা পর্যটকদের জন্য এখানকার ঐতিহ্যবাহী টেক্সটাইল, যেমন—এচিগো-জোফু (Echigo-jofu) সম্পর্কে জানার সুযোগ রয়েছে।
- **রাকুডো-আন (Rakudo-An), তোয়ামা প্রিফেকচার:** এটি একটি পুনরুদ্ধার করা খামারবাড়ি, যেখানে স্থানীয় কারুশিল্পীদের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র প্রদর্শিত ও বিক্রি করা হয়।
- **ইজুমিগায়া ক্রাফট ইন ওয়ারাকু (Izumigaya Craft Inn Waraku), শিজুওকা প্রিফেকচার:** এই হোটেলে আসা পর্যটকরা স্থানীয় কারুশিল্প বিষয়ক কর্মশালায় অংশ নিতে পারেন।
জাপানের এই উদাহরণগুলো থেকে আমরা শিখতে পারি, কীভাবে পর্যটকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলোকে বাঁচানো যায়। আমাদের দেশেও, স্থানীয় সংস্কৃতি ও কারুশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক