যুদ্ধবিধ্বস্ত খারকিভে রুশ হামলার বিভীষিকা, ঘুমহীন দিন কাটছে বাসিন্দাদের।
ভোর রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে বিস্ফোরিত হলো সাইরেনের শব্দে। ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে তখন গভীর রাত, ঘড়িতে ১টা।
১৯ বছর বয়সী দিমিত্রি ও ১২ বছরের ওলেক্সি-কে নিয়ে দ্রুত আশ্রয় নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন ইউলিয়া ভেরবিটস্কা। তাদের ভবনটিতে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই, তাই তারা কংক্রিটের দেয়ালের আড়ালে আশ্রয় নিলেন।
তাদের প্রতিবেশীসহ সবাই একই উদ্বেগে ছিলেন, হয়ত এটাই তাদের শেষ মুহূর্ত।
শুক্রবার রাতের এই হামলার আগে, বৃহস্পতিবার একই শহরে বড় ধরনের বোমা হামলায় ১২ জন নিহত হয়। ইউলিয়া জানালেন, “আমি দুদিন ধরে ঘুমাতে পারিনি।”
ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে কাঁচের টুকরা পরিষ্কার করতে করতে ক্লান্ত বাসিন্দারা জানাচ্ছিলেন, হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্ট করেছিলেন, যেখানে তিনি ‘ভ্লাদিমির, থামুন’ লিখেছিলেন।
খারকিভের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ‘হার্ট অফ খারকিভ’ নামে একটি দাতব্য সংস্থার অফিসে কাজ করেন ইউলিয়া। রুশ হামলায় সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ধ্বংসস্তূপের মধ্যে শিশুদের আঁকা ছবিগুলো ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পড়ে ছিল। অফিসের হুইলচেয়ার ও শিশুদের ব্যবহারের সরঞ্জামগুলো অক্ষত ছিল।
ইউলিয়া বলেন, “আমি কোনো প্রতিশ্রুতি বা কথায় বিশ্বাস করি না, ট্রাম্প বা অন্য কারো থেকেই না। এখন আর কোনো কিছুতেই তেমন আস্থা নেই।”
সকাল গড়িয়ে যাওয়ার পরেও, দমকলকর্মীরা ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি পুরনো সাবান কারখানায় আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলেন। ১৯১৮ সালে নির্মিত কারখানাটি একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য সাবান তৈরি করত।
গত বছর এটি দেউলিয়া হয়ে যায়। কারখানার প্রবেশদ্বারের পাশে থাকা একটি পুরনো আকাশিয়া গাছের পাশ দিয়ে রাশিয়ার ড্রোনগুলো উড়ে গিয়েছিল।
একটি ইটের তৈরি প্রশাসনিক ভবন সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। কারখানার নিরাপত্তা রক্ষী আন্তন রুশদের সম্পর্কে বলেন, “ওরা ফ্যাসিস্ট, অমানবিক, বর্বর এবং নিষ্ঠুর। তারা ইউক্রেন ও ইউক্রেনীয়দের ধ্বংস করতে চায়, এটাই তাদের পরিকল্পনা।”
আন্তন আরও জানান, শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি সন্দিহান। তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী ক্রিমিয়া এবং আরও চারটি ইউক্রেনীয় অঞ্চল রাশিয়াকে দেওয়া হলে, জেলেনস্কি’র তা গ্রহণ করা উচিত হবে না। আন্তন ট্রাম্পকে “ long ago recruited” হিসেবেও অভিহিত করেন।
এদিকে, রাশিয়ার বোমা হামলার শিকার হওয়াদের মধ্যে বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। বৃহস্পতিবার কিয়েভে নিহত হওয়া দুটি শিশুর মরদেহ তাদের অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
খারকিভের সলোবিডস্কি জেলার বাসিন্দা লিউডমিলা হানজি তার বাড়িতে ছিলেন, যখন সাবান কারখানায় হামলা হয়। তার ছেলে আন্দ্রেই জানান, বোমা হামলায় ঘরের কাঁচ ভেঙে যায়।
লিউডমিলা সামান্য আহত হলেও তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
খারকিভ ফায়ার স্টেশনের ডেপুটি প্রধান আনাতোলি ইয়াসকোভেটসের মতে, রাশিয়া তাদের বিমান হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে। তিনি জানান, জানুয়ারিতে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে হামলার সংখ্যা বেড়েছে।
গত বছর রাশিয়ার সেনারা খারকিভ দখলের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ইউক্রেনীয় সেনারা তাদের প্রতিহত করে শহরের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। ইয়াসকোভেটসের ধারণা, রাশিয়া আবারও খারকিভকে ঘিরে ফেলতে পারে।
খারকিভের একটি পেট্রোল পাম্পে কফি বিরতিতে আসা ক্র্যাকেন রেজিমেন্টের সেনারা জানান, রাশিয়ার এমন আচরণ তাদের কাছে নতুন নয়।
তাদের মধ্যে সাইফুলা নামের এক সেনা সদস্য বলেন, “আমার মনে হয়, ট্রাম্প আসলে প্রেসিডেন্ট নন, তিনি যেন প্রেসিডেন্টের একটি প্যারোডি বা নকল। পুরো বিশ্ব তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে।
এখন আমাদের একমাত্র উপায় হলো শক্তিশালী একটি সেনাবাহিনী তৈরি করা এবং লড়াই চালিয়ে যাওয়া।”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান