ব্যাংককের কোলাহলপূর্ণ শহরের মাঝেও লুকিয়ে আছে এক শান্ত, স্নিগ্ধ জগৎ—যেখানে প্রকৃতির নীরবতা আর স্থানীয় সংস্কৃতির ছোঁয়া একইসঙ্গে পাওয়া যায়। থাইল্যান্ডের এই ব্যস্ততম শহরের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা কিছু গোপন স্থান, যা ভ্রমণকারীদের কাছে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটি প্রতিবেদনে ব্যাংককের এই অন্য রূপটি তুলে ধরা হয়েছে, যা আমাদের পরিচিত শহরের ধারণাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়।
চাও ফ্রায়া নদীর তীরে অবস্থিত ব্যাংকক শহর, যা তার ঝলমলে আলো এবং কোলাহলপূর্ণ জীবনের জন্য সুপরিচিত। কিন্তু এই শহরের ভেতরের শান্ত রূপটি অনেকের কাছেই অজানা।
পর্যটকদের ভিড় আর গাড়ির হট্টগোলের মাঝেও এখানে এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানে প্রকৃতির নীরবতা উপভোগ করা যায়। তেমনই একটি অভিজ্ঞতার কথা জানা যায়, যেখানে ক্যাপ্টেন তাই নামের একজন ব্যক্তির সৌর-চালিত নৌকায় চড়ে ভ্রমণের সুযোগ হয়।
ক্যাপ্টেন তাই, যিনি একসময় আন্দামান সাগরে ইয়ট চালাতেন, এখন ব্যাংককের অভ্যন্তরীণ খালগুলিতে সৌর-চালিত নৌকা চালান। তার নৌকায় চড়ে ভ্রমণ করা মানে শহরের কোলাহল থেকে দূরে, শান্ত ও নীরব পরিবেশে প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়া।
এই নৌকার ধীর গতি, যা শব্দহীনভাবে বয়ে চলে, শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে মুক্তি দেয় এবং ভ্রমণের এক ভিন্ন স্বাদ এনে দেয়।
এই ভ্রমণের শুরু হয় শহরের পশ্চিমাংশের খাল ধরে। পর্যটকদের সাধারণ ‘গিয়ে-দেখা’ নৌ-ভ্রমণের ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে ক্যাপ্টেন তাই তার যাত্রীদের নিয়ে যান এমন কিছু স্থানে, যেখানে শহরের আসল সৌন্দর্য লুকানো রয়েছে।
পথে দেখা যায়, পুরোনো দিনের চালকলের পাশে শিশুরা খেলা করছে, যা গরম থেকে মুক্তি পাওয়ার এক আনন্দময় উপায়। আবার কোথাও চোখে পড়ে অত্যাধুনিক স্থাপত্যের বাড়ি, যা যেন এক ভিন্ন জগৎ তৈরি করে।
ভ্রমণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ওয়াট রাতচাওরারাসারাম মন্দির পরিদর্শন। এই মন্দিরটি রাজার আমলে সংস্কার করা হয়েছিল এবং এর স্থাপত্যশৈলী পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
মন্দিরের শান্ত পরিবেশ, যা ধ্যান ও প্রার্থনার জন্য উপযুক্ত, ব্যাংককের অন্যান্য জনপ্রিয় স্থান থেকে একে আলাদা করে।
শুধু মন্দির নয়, ব্যাংককের কিছু এলাকাও শান্তি ও নীরবতার আশ্রয়স্থল। কুডি চিন তেমনই একটি জায়গা, যেখানে পর্তুগিজ সম্প্রদায়ের বসবাস।
সরু গলি, পুরনো বাড়িঘর আর স্থানীয় দোকানগুলোর মাধ্যমে এই এলাকাটি তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এখানে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণ হলো পর্তুগিজ-চীনা সংস্কৃতির মিশ্রণে তৈরি ‘খানম ফারং কুডি চিন’ নামক বিশেষ কেক।
এরপর ক্যাপ্টেন তাই তার ভ্রমণ শেষ করেন থনবুরি এলাকার একটি বাগানে, যা আসলে ‘পুমজাই গার্ডেন’ নামে পরিচিত। এই বাগানটি এক পরিবারের তত্ত্বাবধানে রয়েছে এবং এটি শহরের মানুষের জন্য প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগের এক দারুণ সুযোগ।
এই বাগানে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা, ফুল এবং পাখির আনাগোনা মনকে শান্তি এনে দেয়।
পুমজাই গার্ডেনের মালিকের বন্ধু, অ্যান্ডি, জানান যে তার পরিবারের সদস্যরা কীভাবে এই বাগানটিকে টিকিয়ে রেখেছেন। এককালের লিচু বাগানটি এখন একটি সবুজ উদ্যান, যেখানে প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়।
অ্যান্ডির মা, যিনি এই উদ্যানের দেখাশোনা করেন, তার কথায়, “এই বাগান আমার তৃতীয় সন্তান।”
বাগানের ভেতরে একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে, যেখানে অ্যান্ডির পরিবারের পুরনো রেসিপি অনুযায়ী খাবার পরিবেশন করা হয়। এখানে ক্যাপ্টেন তাইয়ের পছন্দের একটি খাবার পাওয়া যায়, যা হলো স্পাইসি পোমেলো সালাদ।
এই সালাদটি শান্ত পরিবেশে বসে উপভোগ করার এক দারুণ সুযোগ।
বর্তমানে, এই বাগানে লিচু গাছ খুঁজে পাওয়া কঠিন। অ্যান্ডি জানান, নগরায়নের কারণে লিচুর বাগানগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। তবে তারা চেষ্টা করছেন, যাতে এই সবুজ স্থানটি টিকিয়ে রাখা যায় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এর গুরুত্ব তুলে ধরা যায়।
ব্যাংককের এই শান্ত ও নীরব স্থানগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শহরের কোলাহলের মাঝেও প্রকৃতির নীরবতা উপভোগ করা সম্ভব।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক