ত্রিনিদাদ ও টোবাগো: অপ্রত্যাশিত নির্বাচনে কি হবে?

ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দেশ ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে (Trinidad and Tobago) আসন্ন সাধারণ নির্বাচন নিয়ে চলছে চরম উত্তেজনা। বিশ্লেষকদের মতে, কয়েক দশকের মধ্যে এবারের নির্বাচন সবচেয়ে অনিশ্চিত হতে চলেছে।

প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যাচ্ছে, আর এর কারণ হলো– ক্রমবর্ধমান অপরাধ, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতির মতো বিষয়গুলো।

এই নির্বাচনে ভোটাররা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন, যারা পাঁচ বছরের জন্য দেশটির ৪১ জন সংসদ সদস্যের আসনে বসবেন। নির্বাচনের মূল কারণ হলো, সাবেক প্রধানমন্ত্রী কিথ রওলি’র (Keith Rowley) পদত্যাগ।

তিনি কোনো নির্বাচনে না হেরেও প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন, যা ছিল নজিরবিহীন। এরপর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ৫০ বছর বয়সী স্টুয়ার্ট ইয়ং (Stuart Young)।

দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি পার্লামেন্ট ভেঙে দেন এবং নির্বাচনের ঘোষণা করেন।

অন্যদিকে, বিরোধী দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল কংগ্রেসের (United National Congress – UNC) নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৭৩ বছর বয়সী কমলা পারসাদ-বিসেসার (Kamla Persad-Bissessar)। তিনি ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

তাঁর দল অভ্যন্তরীণ কোন্দল, গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের পদত্যাগ এবং বিভিন্ন নির্বাচনে পরাজয়ের শিকার হয়েছে। কিন্তু এখনো তাঁর প্রতি জনগণের সমর্থন রয়েছে।

তিনি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অপরাধ দমন ও জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার অভিযোগ এনেছেন।

নির্বাচনটি এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন দেশটিতে তিন মাস ধরে জরুরি অবস্থা জারি ছিল। গত বছর, প্রায় ১৫ লাখ জনসংখ্যার এই দেশে ৬২৪টি হত্যাকাণ্ড রেকর্ড করা হয়েছে, যা ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম সহিংস হিসেবে চিহ্নিত।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামিদ ঘানি (Hamid Ghany) বলেন, “অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা নির্বাচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে।”

বিরোধী দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল কংগ্রেস (ইউএনসি) অপরাধ দমনের জন্য নতুন প্রতিরক্ষা ও বিচার মন্ত্রণালয় তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন দল পিএনএম (PNM) আধুনিক শাসন ব্যবস্থা, ডিজিটাল পরিষেবা এবং একটি বাস্তবায়ন ও দক্ষতা মন্ত্রণালয় তৈরি করে জননিরাপত্তা উন্নত করার কথা বলছে।

সম্প্রতি, টিএন্ডটি গার্ডিয়ান (T&T Guardian) পত্রিকার জন্য করা এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, ত্রিনিদাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আসনে ইউএনসি এগিয়ে আছে, তবে টোবাগোতে পিএনএমের সমর্থন বেশি।

ত্রিনিদাদের ১১টি নির্বাচনী এলাকার ১,৬৫০ জন ভোটারের মধ্যে ৪৫ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা ইউএনসিকে ভোট দেবেন, যেখানে পিএনএমের পক্ষে ভোট দেওয়ার কথা বলেছেন ৩০ শতাংশ ভোটার।

জরিপে আরও দেখা গেছে, গত এক দশকে পিএনএমের কার্যকারিতায় ৬১ শতাংশ ভোটার অসন্তুষ্ট।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঘানি এই নির্বাচনকে ‘শ্রমজীবী ও সুবিধাভোগী শ্রেণির’ মধ্যেকার লড়াই হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

৩৫ বছর বয়সী ক্লিন্তন ব্রুস্টার (Clinton Brewster) এর মতো সাধারণ মানুষের প্রধান উদ্বেগ হলো জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়, যা তাঁদের বেতনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

ঘানি আরও যোগ করেন, “শ্রমিক ইউনিয়নগুলো কোভিড-পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য শ্রমিক শ্রেণির উদ্বেগের বিষয়গুলো সমাধানে সরকারের বিরুদ্ধে ইউএনসিকে সমর্থন জানাচ্ছে।

শ্রেণিগত এই বিভাজন জাতিগত বিভেদকে ছাপিয়ে গেছে, যা এই নির্বাচনে জাতিগত বিষয়টিকে কিছুটা দুর্বল করেছে।”

ঐতিহাসিকভাবে, ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর রাজনীতিতে জাতিগত বিভাজন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পিএনএম সাধারণত আফ্রো-ত্রিনিদাদীয় এবং ইউএনসি ইন্দো-ত্রিনিদাদীয় সম্প্রদায়ের সমর্থন পেয়ে থাকে।

যদিও দল দুটি জাতিগত বিভাজনকে কাজে লাগানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে, তবুও এবারের নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করে তৈরি করা বিজ্ঞাপনে জাতিগত বার্তা এবং শ্রেণিগত প্রতিনিধিত্ব নিয়ে অভিযোগ উঠেছে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

ঘানির মতে, “যুক্তরাষ্ট্রের ভেনেজুয়েলার প্রতি নীতি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।” সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্র ত্রিনিদাদ ও টোবাগো এবং ভেনেজুয়েলার মধ্যে অফশোর গ্যাস প্রকল্পের উন্নয়নের জন্য দেওয়া দুটি লাইসেন্স বাতিল করেছে, যা দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি ধাক্কা।

ঘানি আরও বলেন, “পিএম ইয়ং এবং [ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট] মাদুরোর মধ্যেকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ট্রাম্প প্রশাসনের নজরে থাকবে, যদি পিএনএম নির্বাচনে জয়ী হয়।

যদি ইউএনসি জয়ী হয়, তাহলে ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া আসার সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ কমলা পারসাদ-বিসেসার ট্রাম্পের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন।”

তথ্যসূত্র: The Guardian

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *