পুরুষদের চোখের পাপড়ি কামানোর হিড়িক: কেন এই প্রবণতা?
সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে আজকাল প্রায়ই চোখে পড়ছে এক নতুন দৃশ্য—পুরুষরা তাদের চোখের পাপড়ি ছোট করে কাটছেন বা সম্পূর্ণভাবে কামিয়ে ফেলছেন। পশ্চিমা বিশ্বে, বিশেষ করে, এই প্রবণতা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
প্রশ্ন হলো, কেন? আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ এই ঘটনার পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর কিছু কারণ, যা লিঙ্গপরিচয়, সৌন্দর্যবোধ এবং সমাজের চোখে পুরুষের সংজ্ঞা—সবকিছুকেই নতুন করে ভাবিয়ে তোলে।
আসলে, চোখের পাপড়ি (চুলের মতো) আমাদের চোখের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরা বাইরের ধুলোবালি, রোদ এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক উপাদান থেকে চোখকে বাঁচায়।
চোখের পলক ফেলার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়ও পাপড়ি সহায়ক। কিন্তু সম্প্রতি “পুরুষালি” (masculine) চেহারার ধারণা জনপ্রিয় হওয়ায় অনেকেই নিজেদেরকে আরও “পুরুষালি” প্রমাণ করতে এই পথে হাঁটছেন।
টিকটক (TikTok), ইনস্টাগ্রাম (Instagram) এবং এক্স (X)-এর মতো প্ল্যাটফর্মে এই সম্পর্কিত ভিডিওর ছড়াছড়ি।
তুরস্ক থেকে নিউজিল্যান্ড—বিভিন্ন দেশের সেলুনগুলোতেও এই ধরনের “পুরুষালি” লুক তৈরির চেষ্টা চলছে। কেউ কেউ ক্ষুর ব্যবহার করছেন, আবার কেউ কাঁচি দিয়ে পাপড়ি ছোট করছেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, চোখের পাপড়ি কামানো বা ছোট করার এই প্রবণতা চোখের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের চক্ষু বিশেষজ্ঞ ড. ভিকি লি’র মতে, “পাপড়ি অপসারণের ফলে চোখে অস্বস্তি হতে পারে এবং চোখের পৃষ্ঠে ধারালো প্রান্ত তৈরি হতে পারে, যা চোখের ক্ষতি করতে পারে।”
পুরুষের “পুরুষালি” রূপের ধারণার সঙ্গে এই প্রবণতার যোগসূত্র রয়েছে।
অতীতে, লম্বা এবং ঘন পাপড়িকে নারীত্বের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। সৌন্দর্য এবং ফ্যাশনের জগতে এর একটি বিশেষ স্থান ছিল।
কিন্তু এখনকার সমাজে, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা আরও জোরদার হচ্ছে। “ম্যানোস্ফিয়ার” (manosphere) এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব যেমন অ্যান্ড্রু টেট (Andrew Tate) ও মেটা (Meta)-র প্রধান মার্ক জাকারবার্গের (Mark Zuckerberg) মতো প্রযুক্তি উদ্যোক্তারা “পুরুষালি শক্তি” (masculine energy)-র পক্ষে কথা বলছেন।
এর ফলস্বরূপ, অনেক পুরুষ তাদের চেহারার সেই দিকগুলো গোপন করতে চাইছেন, যা তাদের “নারীসুলভ” করে তোলে।
যুক্তরাষ্ট্রে রক্ষণশীলদের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী লিঙ্গ পরিচয়ের ধারণা ক্রমশ বাড়ছে।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, রিপাবলিকান পুরুষ ও নারীদের মধ্যে একটি বড় অংশ মনে করেন, “পুরুষত্বের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়েছে এবং এটি সমাজের জন্য ভালো কিছু নয়।”
নারীদের “ঐতিহ্যবাহী ভূমিকায়” ফিরে যাওয়া উচিত বলেও অনেকে মনে করেন।
অন্যদিকে, নারীদের মধ্যে “নো-মাসকারা” (#fullfacenomascara) নামক একটি প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে, যেখানে তারা তাদের স্বাভাবিক চোখের পাপড়ি দেখাচ্ছেন।
এই প্রবণতা কি পুরুষদের এই নতুন ফ্যাশনের প্রতিক্রিয়া?
ফ্যাশন এবং সৌন্দর্য সব সময়ই একটি চক্র অনুসরণ করে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রুচি বদলায়, এবং এর প্রতিফলন দেখা যায় পোশাকেও।
১৯৬০-এর দশকে যেমন অনেকে নারী-পুরুষের মধ্যেকার পোশাকের বিভাজনটা প্রায় ভুলতে বসেছিলেন, আবার ১৯৮০-র দশকে মার্গারেট থ্যাচারের (Margaret Thatcher) রক্ষণশীল নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে লন্ডনের ফ্যাশন জগতে নতুনত্বের ছোঁয়া লেগেছিল।
সুতরাং, চোখের পাপড়ি কামানোর এই প্রবণতা শুধু একটি ফ্যাশন ট্রেন্ড নয়, বরং সমাজে পুরুষত্ব এবং নারীর সংজ্ঞা নিয়ে চলমান বিতর্কেরই একটি অংশ।
তথ্য সূত্র: CNN