কেন আগের চেয়ে বেশি মানুষ ম্যারাথন দৌড়াচ্ছে?

শিরোনাম: ম্যারাথন দৌড়: বিশ্বজুড়ে বাড়ছে আগ্রহ, অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে মানবিক দিক

দৌড় ভালোবাসেন এমন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। শুধু শারীরিক সুস্থতাই নয়, এর বাইরেও অনেক কারণ রয়েছে, যা মানুষকে ম্যারাথন দৌড়ের দিকে আকৃষ্ট করছে। সম্প্রতি লন্ডনে অনুষ্ঠিত হওয়া ম্যারাথনে অংশ নেওয়া হাজারো মানুষের গল্প যেন তারই প্রমাণ।

প্রতি বছর, লন্ডনের ম্যারাথন দৌড় শুধু একটি ক্রীড়া ইভেন্ট নয়, এটি পরিণত হয়েছে এক বিশাল মানবিক মিলনমেলায়। এই দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া প্রত্যেক মানুষের রয়েছে নিজস্ব গল্প, যা তাদের এই চ্যালেঞ্জিং পথ পাড়ি দিতে উৎসাহিত করে। কারো কাছে এটি প্রিয়জনের স্মৃতি ধরে রাখার উপায়, আবার কারো কাছে এটি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির হাতিয়ার। অনেকে আবার সমাজের জন্য কিছু করতে চান, তাই এই দৌড়ের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে বিভিন্ন দাতব্য সংস্থায় অনুদান করেন।

এবারের লন্ডন ম্যারাথনে প্রায় ৫৬,০০০ এর বেশি দৌড়বিদ অংশ নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন এমন অনেকে, যারা প্রিয়জন হারানোর শোককে জয় করতে, কিংবা কঠিন শারীরিক চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করতে দৌড়েছেন। বিবিসির একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, লন্ডন ম্যারাথন শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১.৩ বিলিয়ন পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি) সংগ্রহ করা হয়েছে, যা বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে ব্যয় করা হয়।

এই ম্যারাথনে অংশ নেওয়া মানুষের অনুপ্রেরণার একটি বড় উৎস হলো প্রিয়জনদের প্রতি তাদের গভীর ভালোবাসা। যেমন, জুলি রাইট নামের এক নারী তার মেয়ের মৃত্যুর পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। পরে তিনি দৌড়কে বেছে নেন, যা তাকে শোক কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, তিনি তার মেয়ের স্মরণে একটি দাতব্য সংস্থার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন।

অন্যান্য দৌড়বিদদের মধ্যেও একই ধরনের আবেগ দেখা যায়। ১৯ বছর বয়সী জমজ বোন, কেটি এবং আনা রাওল্যান্ড তাদের বাবার স্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে দৌড়েছেন। তাদের বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন এবং মৃত্যুর আগে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেই হাসপাতালের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে এবং তাদের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহ করতে তারা এই ম্যারাথনে অংশ নেন। তাদের মতে, “যদি কেউ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে পারে, তাহলে আমরা কয়েক ঘণ্টা দৌড়াতে পারি না কেন?”

শুধু শোক বা ভালোবাসাই নয়, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করারও এক দারুণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ডেভিড ওয়েদারিল নামের একজন প্রতিযোগী। তিনি জন্মগতভাবে শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্মেছিলেন, যার কারণে তার পক্ষে স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করাও কঠিন। কিন্তু তিনি ম্যারাথনে অংশ নিয়ে প্রমাণ করেছেন, ইচ্ছাশক্তি থাকলে সব কিছুই সম্ভব। তিনি টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীদের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহের জন্য এই ম্যারাথনে দৌড়েছেন।

ম্যারাথনে অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজন কঠোর প্রশিক্ষণ। দিনের পর দিন অনুশীলন করে শরীরকে প্রস্তুত করতে হয়। লুক রচে নামের একজন প্রতিযোগী তার অফিসের কাজ ও পরিবারের দেখাশোনার পাশাপাশি নিয়মিত প্রশিক্ষণ চালিয়ে গেছেন। তিনি জানান, তার স্ত্রী তাকে সবসময় সাহায্য করেছেন এবং এই দৌড়ে অংশগ্রহণের জন্য তিনিই সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।

এছাড়াও, অনেকে আছেন যারা কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এই দৌড়ে অংশ নেন। জেনি টোলান্ড নামের একজন নারী, যিনি সন্তান ধারণের জটিলতার শিকার হয়েছিলেন, একটি দাতব্য সংস্থার সহায়তায় মা হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন। সেই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ, তিনি এই ম্যারাথনে দৌড়েছেন এবং প্রমাণ করেছেন, কিভাবে একটি ভালো কাজ মানুষের জীবনকে বদলে দিতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের মধ্যে ম্যারাথন দৌড়ের আগ্রহ বাড়ছে, কারণ এটি শুধুমাত্র একটি খেলা নয়, এটি একটি জীবনবোধ। বর্তমানে, শুধু যুক্তরাজ্যেই নয়, সারা বিশ্বেই ম্যারাথন দৌড় একটি জনপ্রিয় ইভেন্ট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। মানুষের মধ্যে এই দৌড়ের প্রতি আগ্রহ বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলো, এটি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সহজলভ্য। বিভিন্ন রান ক্লাব এবং পার্ক-এর দৌড়ের আয়োজন এই খেলাটিকে সকলের কাছে আরও বেশি পরিচিত করে তুলেছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, গত সাত বছরে লন্ডন ম্যারাথনে অংশগ্রহণের জন্য আবেদনকারীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। শুধু তাই নয়, গত বছর নিউ ইয়র্ক সিটি ম্যারাথনে ৫৬,০০০ এর বেশি মানুষ অংশ নিয়েছিল, যা একটি রেকর্ড। এবার সেই রেকর্ডও ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

যারা দৌড় ভালোবাসেন, তাদের জন্য ম্যারাথন একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এটি তাদের শারীরিক সক্ষমতা প্রমাণ করার সুযোগ দেয়, তেমনিভাবে মানসিক শান্তিরও একটি পথ তৈরি করে।

তথ্যসূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *