ঐতিহাসিক স্থাপত্য হাগিয়া সোফিয়া: সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন সাক্ষী এক বিস্ময়।
ইস্তাম্বুলের (সাবেক কন্সটান্টিনোপল) বুকে অবস্থিত হাগিয়া সোফিয়া (Hagia Sophia) শুধু একটি স্থাপত্যই নয়, এটি ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল।
প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে এটি সাম্রাজ্য, ধর্ম, এবং সংস্কৃতির পালাবদলের সাক্ষী। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সময় নির্মিত একটি গির্জা থেকে অটোমান সাম্রাজ্যে মসজিদে রূপান্তর, আবার জাদুঘর হয়ে পুনরায় মসজিদের মর্যাদা ফিরে পাওয়া – হাগিয়া সোফিয়ার এই বিবর্তন আজও বিশ্বজুড়ে আলোচনার বিষয়।
৬ষ্ঠ শতকে, যখন কন্সটান্টিনোপল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল, সেই সময়ে সম্রাট জাস্টিনিয়ান-এর (Justinian I) আদেশে তৈরি হয়েছিল হাগিয়া সোফিয়া।
৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। বিশাল গম্বুজ এবং জটিল নকশার এই গির্জাটি ছিল তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এবং অত্যাশ্চর্য স্থাপত্য।
এর ভেতরের স্থান বিশালতার এক মায়া তৈরি করে, যা দর্শকদের মধ্যে এক আধ্যাত্মিক অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। বাইজেন্টাইন শাসকদের মোজাইক এবং ইসলামিক ক্যালিগ্রাফির (Hüsn-i Hat) এক অপূর্ব সহাবস্থান এখানে দেখা যায়, যা এই স্থাপনার অনন্য বৈশিষ্ট্য।
তবে হাগিয়া সোফিয়ার বর্তমান রূপটি প্রথম নয়। এর আগে একই স্থানে আরও দুটি গির্জা নির্মিত হয়েছিল, যা সময়ের বিবর্তনে ধ্বংস হয়ে যায়।
প্রথমটি তৈরি করেছিলেন সম্রাট কনস্টানটাইন, যিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে রোমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্র কন্সটান্টিনোপলে স্থানান্তরিত করেন। পরবর্তীতে, জাস্টিনিয়ানের আমলে নির্মিত হয় আজকের হাগিয়া সোফিয়া, যা স্থাপত্যশৈলীর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
কথিত আছে, জাস্টিনিয়ান চেয়েছিলেন এই গির্জাটি যেন জেরুজালেমের সলোমনের মন্দির থেকেও বৃহৎ হয়।
ঐতিহাসিক তথ্য বলছে, এর নির্মাণ ব্যয় ছিল আকাশছোঁয়া – যা আজকের দিনে প্রায় ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান!
১৪৫৩ সালে অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ (Mehmed the Conqueror) কন্সটান্টিনোপল জয় করার পর হাগিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন।
তিনি এটিকে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
যদিও হাগিয়া সোফিয়ার নামকরণ গ্রিক শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘পবিত্র জ্ঞান’, কিন্তু এর স্থাপত্যে খ্রিস্টান ও ইসলামিক সংস্কৃতির এক মিশ্রণ দেখা যায়।
সুলতান মেহমেদ-এর নির্দেশে এখানে প্রথম জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীতে এটি অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতানদের জন্য একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়।
সময়ের সাথে সাথে হাগিয়া সোফিয়া বহুবার ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
ভূমিকম্প, যুদ্ধ এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও এটি আজও টিকে আছে।
অটোমান শাসনামলে এর রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছিল, বিশেষ করে সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদের সময়ে।
পরবর্তীতে, আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের (Mustafa Kemal Atatürk) সময়ে, ১৯৩৫ সালে এটিকে জাদুঘরে (jadughor) রূপান্তর করা হয়।
তবে হাগিয়া সোফিয়ার এই পরিবর্তন এখানেই শেষ হয়নি।
২০২০ সালে তুরস্ক সরকার বিতর্কিত এক সিদ্ধান্তে এটিকে পুনরায় মসজিদে (mosjid) রূপান্তরিত করে।
যদিও আন্তর্জাতিক মহলে এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছিল, তুরস্কের মুসলিম সমাজে এর সমর্থন ছিল ব্যাপক।
বর্তমানে, হাগিয়া সোফিয়ার একটি অংশ জাদুঘর হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে, যেখানে পর্যটকরা প্রবেশ করতে পারেন এবং ঐতিহাসিক মোজাইকগুলো দেখতে পারেন।
হাগিয়া সোফিয়া নিয়ে অনেক কিংবদন্তী প্রচলিত আছে।
এর মধ্যে একটি হল, ভূমিকম্পের কারণে যখন এর গম্বুজে ফাটল ধরেছিল, তখন সেটি সারানোর জন্য বিশেষ ধরনের মর্টার ব্যবহার করা হয়েছিল, যেখানে পবিত্র পানি এবং পবিত্র মাটি মেশানো হয়েছিল।
এই ধরনের গল্পগুলো হাগিয়া সোফিয়ার প্রতি মানুষের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে তোলে।
বর্তমানে, হাগিয়া সোফিয়া একদিকে যেমন তুরস্কের মুসলিমদের কাছে পবিত্র স্থান, তেমনই এটি বিশ্বজুড়ে আসা পর্যটকদের কাছে এক আকর্ষণীয় গন্তব্য।
২০২৩ সালে এখানে একটি বৃহৎ সংস্কার প্রকল্পের (conservation project) কাজ শুরু হয়েছে, যা এর ভূমিকম্পন ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি ঐতিহাসিক মোজাইকগুলোর সংরক্ষণ করবে।
এই সংস্কারের ফলে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকরা এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে।
হাগিয়া সোফিয়া শুধু একটি স্থাপত্য নয়, এটি ইতিহাসের এক অমূল্য অংশ, যা আজও তার গল্প বলে চলেছে।
তথ্য সূত্র: আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম।