বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে হাঁটু ব্যথার সমস্যা বেশ সাধারণ, বিশেষ করে যাদের বসে কাজ করার অভ্যাস অথবা ভারী শারীরিক পরিশ্রম করতে হয়। অনেক সময় এই ব্যথার আসল কারণটা থাকে আমাদের কোমর বা হিপের দুর্বলতা বা কাঠিন্যের মধ্যে।
বিখ্যাত ‘মোবিলিটি মেকার’ এবং পেশাদার ক্রীড়াবিদদের প্রশিক্ষক ডানা সান্তাসের মতে, হাঁটু ভালো রাখতে হলে কোমরকে সুস্থ রাখাটা জরুরি।
আসলে, আমাদের হিপ বা কোমরের সংযোগস্থল একটি বল ও সকেট জয়েন্টের মতো, যা নানা দিকে সহজে ঘুরতে পারে। অন্যদিকে, হাঁটু হল কব্জা-সন্ধির মতো, যা সাধারণত সামনে-পেছনে বাঁকতে পারে।
যখন কোমরের পেশিগুলো দুর্বল হয়ে পরে বা শক্ত হয়ে যায়, তখন হাঁটুকেই সেই ঘাটতি পূরণ করতে হয়। ফলে হাঁটুর উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং ধীরে ধীরে সেখানে ব্যথা শুরু হয়।
কোমরের কাঠিন্য কেন হাঁটুতে সমস্যা তৈরি করে? আমাদের কোমর নড়াচড়ার স্বাধীনতা দেয়, কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় হিপের পেশিগুলো দুর্বল বা শক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে হাঁটু স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না।
উদাহরণস্বরূপ, কোমর বাইরের দিকে স্থিতিশীল রাখতে হিপের বাইরের দিকের পেশিগুলো কাজ করে। এই পেশিগুলো দুর্বল হলে উরুর হাড় ভেতরের দিকে বেঁকে যেতে পারে, যার ফলে হাঁটুর বাইরের দিকে অতিরিক্ত চাপ পড়ে।
এছাড়া, শ্রোণী বা পেলভিস অঞ্চলের সঠিক নড়াচড়া না হলে উরুর হাড় এবং শিনের হাড়ের মধ্যে একটি অস্বাভাবিকতা তৈরি হয়। এর কারণে হাঁটু স্বাভাবিকভাবে নাড়াচাড়া করতে পারে না এবং কার্টিলেজের উপর চাপ পড়ে, যা পরবর্তীতে অস্টিওআর্থারাইটিস বা অন্যান্য গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
দিনের বেশিরভাগ সময় বসে কাজ করলে হিপ ফ্লেক্সর পেশিগুলো শক্ত হয়ে যায় এবং গ্লুট পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে কোমর প্রসারিত হতে সমস্যা হয়, শ্রোণী অঞ্চলের স্বাভাবিক বিন্যাস বজায় থাকে না এবং শরীরের নিচের অংশে দুর্বলতা দেখা দেয়।
খেলাধুলা করেন এমন ব্যক্তিদেরও এই সমস্যা হতে পারে। দৌড়ানো, সাইকেল চালানো বা ভারী ওজন তোলার মতো পুনরাবৃত্তিমূলক কাজগুলি, যদি সঠিকভাবে হিপের নড়াচড়ার প্রতি মনোযোগ না দেওয়া হয়, তবে কোমরের স্বাভাবিকতা নষ্ট হতে পারে।
তাহলে বুঝবেন কীভাবে যে আপনার হাঁটু ব্যথার কারণ কোমর? কিছু লক্ষণ দেখে বোঝা যেতে পারে, যেমন—
- বসে থাকার পরে বা সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় হাঁটুতে ব্যথা।
- কোমরের সামনে বা কুঁচকিতে টান ধরা বা শক্ত অনুভব করা。
- কোমরের কিছু স্ট্রেচ করার সময়, যেমন ‘পিigeon pose’ করার সময় হাঁটুতে ব্যথা অনুভব করা।
- ভারসাম্য বজায় রাখতে সমস্যা হওয়া বা এক পায়ে দাঁড়াতে অসুবিধা হওয়া।
- স্কোয়াট বা lunges করার সময় হাঁটু ভেতরের দিকে বেঁকে যাওয়া।
এই ধরনের সমস্যা হলে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। তবে কিছু সাধারণ ব্যায়াম এবং কৌশল অবলম্বন করে কোমরকে সুস্থ রাখা সম্ভব।
১. হিপ ফ্লেক্সর মুক্তি: শক্ত হিপ ফ্লেক্সর কোমরকে প্রসারিত করতে বাধা দেয়, যা হাঁটুর উপর চাপ বাড়ায়। তাই এই পেশিগুলিকে বিভিন্ন উপায়ে প্রসারিত করা প্রয়োজন।
ডানা সান্তাসের মতে, তিন ধরনের হিপ ফ্লেক্সর রিলিজ ব্যায়াম এক্ষেত্রে উপকারী।
২. ভিতরের হিপ এবং পায়ের পেশি শক্তিশালী করা: দুর্বল অ্যাডাক্টর (ভিতরের ঊরুর পেশি) এবং গ্লুট পেশির কারণে উরুর হাড় এবং হাঁটুর সংযোগস্থলে সমস্যা হতে পারে।
নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে এই পেশিগুলোকে শক্তিশালী করে হাঁটুর উপর চাপ কমানো যেতে পারে। গ্লুট ব্রিজ ব্যায়ামের একটি পরিবর্তিত রূপ অনুসরণ করা যেতে পারে—
- সোজা হয়ে শুয়ে হাঁটু বাঁক করে পায়ের পাতা মাটিতে রাখুন।
- দু’ হাঁটুর মধ্যে একটি যোগা ব্লক বা তোয়ালে রাখুন।
- পা দুটি সোজা রাখুন এবং কোমর সামান্য উপরে তুলুন।
- কয়েক সেকেন্ডের জন্য এই অবস্থায় থাকুন এবং ভেতরের ঊরু ও গ্লুট পেশি শক্ত করুন।
- আস্তে আস্তে কোমর নামিয়ে নিন। ১০-১২ বার এই ব্যায়ামটি করুন, ২-৩ সেট করুন।
৩. পার্শ্বীয় লাঞ্জ (lateral lunges) অনুশীলন করুন: শরীরের এক পাশ থেকে অন্য পাশে যাওয়া বা পাশের দিকে হাঁটা-চলার মতো নড়াচড়া হিপের কার্যকারিতার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
হাঁটু যেহেতু এই ধরনের নড়াচড়ার জন্য তৈরি নয়, তাই এই ধরনের ব্যায়ামের মাধ্যমে শক্তি ও নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো প্রয়োজন। পাশের দিকে লাফ দেওয়ার সময়—
- ডান পা এক পাশে রেখে হাঁটু বাঁকিয়ে কোমর পেছনের দিকে নিন, বাম পা সোজা রাখুন।
- বুক সামান্য তুলে কোরের পেশী সক্রিয় রাখুন।
- ডান পা থেকে শক্তি নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ান। প্রতি পাশে ৮-১০ বার করে ২-৩ সেট করুন।
৪. কোমরের পেশি শিথিল করতে ‘সফট-টিস্যু’ কৌশল ব্যবহার করুন: ফোম রোলিং বা ম্যাসাজ গানের মতো কৌশল ব্যবহার করে টিস্যুর গুণগত মান উন্নত করা যেতে পারে।
হিপের পেশি খুব শক্ত হলে স্ট্রেচিং করার আগে এই কৌশলগুলি ব্যবহার করা ভালো। গ্লুটস, বাইরের ঊরু, ভিতরের ঊরু, কোয়াড্রিসেপস (পায়ের সামনের অংশ) এবং হ্যামস্ট্রিং (পায়ের পেছনের অংশ)-এর মতো কোমরের আশেপাশে ৩০-৬০ সেকেন্ড ধরে ম্যাসাজ করুন।
৫. নিরাপদে স্ট্রেচিং করুন: ‘পিigeon pose’-এর মতো কঠিন স্ট্রেচিংগুলি কোমরের জন্য উপকারী হতে পারে, তবে এটি হাঁটুর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
তাই এই ধরনের স্ট্রেচিং করার আগে সতর্ক থাকতে হবে। চেয়ারে বসে ‘ফিগার-ফোর’ স্ট্রেচ বা পরিবর্তিত ‘পিigeon pose’-এর মতো সহজ কৌশলগুলি অনুসরণ করা যেতে পারে, যা হাঁটু সুরক্ষিত রেখে কোমরকে প্রসারিত করতে সাহায্য করে।
মনে রাখবেন, হাঁটুতে ব্যথা অনুভব হলেও, এর মূল কারণ হতে পারে আপনার কোমরের দুর্বলতা। তাই কোমরকে শক্তিশালী করে, এর নড়াচড়ার ক্ষমতা বাড়িয়ে আপনি আপনার হাঁটুতে সঠিক সমর্থন দিতে পারেন এবং ব্যথামুক্ত জীবন যাপন করতে পারেন।
তথ্য সূত্র: সিএনএন