পাকিস্তানের আকাশে বিদ্যুতের নতুন সূর্য: দ্রুত সৌর বিপ্লবের পথে।
পাকিস্তানের শহরগুলোতে এখন যেন ঝলমলে নীল সৌর প্যানেলের ছড়াছড়ি। দেশটির প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতেও দেখা মিলছে এর।
বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশটিতে চলছে দ্রুতগতির সৌর বিপ্লব, যেখানে প্রায় ২৪ কোটির বেশি মানুষের বসবাস। অর্থনৈতিক সংকট আর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে করতেও দেশটি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানে এই সৌর বিপ্লব এসেছে অনেকটা জনগণের হাত ধরেই। এর পেছনে কোনো সরকারি নীতির সরাসরি প্রভাব নেই।
বরং, এটি মূলত বাজার-নির্ভর এবং মানুষের চাহিদার ফল। দেশটির সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা বিদ্যুতের উচ্চমূল্যের কারণে ঝুঁকছেন সৌরবিদ্যুতের দিকে।
চীনের তৈরি সস্তা সৌর প্যানেলের কারণে দেশটি এখন সৌরবিদ্যুতের বিশাল এক বাজারে পরিণত হয়েছে। ২০২৩ সালে দেশটি প্রায় ১৭ গিগাওয়াট সৌর প্যানেল আমদানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
ক্লাইমেট থিংক ট্যাংক এমবারের তথ্য অনুযায়ী, সৌর প্যানেল আমদানির দিক থেকে পাকিস্তান এখন বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
পাকিস্তানের এই সৌর বিপ্লব একটি জটিল বিষয়। একদিকে যেমন এটি একটি ইতিবাচক পরিবর্তন, তেমনই এর সঙ্গে কিছু চ্যালেঞ্জও জড়িত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিবর্তন দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। তবে অনেকেই মনে করেন, এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, পরিষ্কার ও নবায়নযোগ্য শক্তি শুধু ভর্তুকির ওপর নির্ভর করে না, বরং মানুষের আগ্রহ ও অর্থনৈতিক যুক্তিবোধ থেকেও এর প্রসার ঘটতে পারে।
পাকিস্তানের এই সৌর বিপ্লবের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ কাজ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হলো, চীনের তৈরি সৌর প্যানেলের দাম কমে যাওয়া এবং বিদ্যুতের আকাশছোঁয়া দাম।
আশির দশকে পাকিস্তানের বিদ্যুৎ খাতে নেওয়া কিছু ব্যয়বহুল সিদ্ধান্তের কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়তে থাকে। রুপির অবমূল্যায়ন এবং বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গ্যাসসহ অন্যান্য জ্বালানির দাম বাড়ায় সংকট আরও বাড়ে।
গত তিন বছরে পাকিস্তানে বিদ্যুতের দাম ১৫৫ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া, দেশের অনেক অঞ্চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং একটি সাধারণ ঘটনা।
এমন পরিস্থিতিতে যাদের সামর্থ্য আছে, তারা সস্তায় সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, গত বছর পাকিস্তানে প্রায় ১৫ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে দেশটির বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ৩০ গিগাওয়াট।
পাকিস্তানের এই সৌর বিপ্লব কীভাবে সম্ভব হলো?
পাকিস্তানের সোলার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ওয়াকাস মুসার মতে, এটি একটি “পারফেক্ট স্টর্ম”-এর ফল।
তিনি একে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্থানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যেমন, টিকটক ও ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো মানুষকে ঐতিহ্যবাহী মিডিয়ার বাইরে গিয়ে নিজেদের কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে, তেমনি সৌর বিপ্লবও পাকিস্তানিদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহারের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে।
তবে এই বিপ্লবের কিছু সমস্যাও রয়েছে। ওয়াকাস মুসা মনে করেন, এতে দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
কারণ, সৌরবিদ্যুতের দিকে ঝুঁকলে বিদ্যুতের চাহিদা কমবে, ফলে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর আয় কমে যাবে। এতে যারা গ্রিডের ওপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য বিদ্যুতের দাম আরও বাড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সৌর বিপ্লব ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্যও তৈরি করতে পারে। কারণ, সৌরবিদ্যুৎ কেনার সামর্থ্য সবার নেই।
ফলে, সমাজের একটি অংশ যেখানে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে, সেখানে অন্য অংশটি এখনো পুরনো এবং ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল।
তবে অনেকে মনে করেন, সৌরবিদ্যুৎ শুধু ধনীদের জন্য সীমাবদ্ধ নয়।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ, যেখানেGrid electricity-র সুবিধা খুবই কম, তারাও এখন সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। গ্রামের একটি টায়ারের দোকানে প্রতিদিন সকালে একটি সৌর প্যানেল দেখা যায়।
এমনকি, অনেক পরিবার তাদের ডিজেল-চালিত সেচ পাম্পের পরিবর্তে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের এই অভিজ্ঞতা অন্যান্য দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে, যেখানে বিদ্যুতের দাম বেশি বা সরবরাহ নির্ভরযোগ্য নয়।
জলবায়ু বিষয়ক কর্মী হারজিৎ সিংয়ের মতে, সৌরবিদ্যুতের দাম কমে যাওয়া এটি জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দূরে থাকার সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত উপায়।
তবে গ্রিড ব্যবস্থাপনার জন্য আগে থেকে পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ করা অপরিহার্য।
পাকিস্তানের এই সৌর বিপ্লব যদি সফল হয়, তবে এটি বিশ্বজুড়ে সৌরবিদ্যুৎ প্রসারের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
তাই, দেশটির জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তাদের সৌরবিদ্যুৎ বিষয়ক গল্পটিকে একটি সফল দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা, যা অনুসরণযোগ্য।
তথ্য সূত্র: সিএনএন