মহিলাদের মেনোপজ বা ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়া নিয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চলেছে চিকিৎসা বিজ্ঞান। ডিম্বাশয়ের বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করে কিভাবে এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করা যায়, সেই বিষয়ে গবেষণা চলছে জোর কদমে।
সম্প্রতি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটি প্রতিবেদনে এই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
সাধারণত, মহিলাদের বয়স চল্লিশের কোঠায় পৌঁছালে শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের মাত্রা কমতে শুরু করে। এই পরিবর্তনের সময়টিকে পেরিমেনোপজ বলা হয়, যা কয়েক বছর থেকে এক দশক পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
এরপর আসে মেনোপজ, যখন মাসিক চক্র এক বছরের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এই সময়কালে মহিলাদের মধ্যে হট ফ্লাশ, রাতের বেলা ঘাম, যৌন মিলনে কষ্ট, জয়েন্টে ব্যথা, এবং মানসিক ও শারীরিক বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা যায়।
যদিও হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (এইচআরটি) কিছু ক্ষেত্রে এই সমস্যাগুলো কমাতে পারে, তবে মেনোপজের কারণে হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার মতো কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে, যা এইচআরটি দিয়ে পুরোপুরি কমানো সম্ভব নয়।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন এমন কিছু পদ্ধতির ওপর কাজ করছেন, যা মেনোপজের শুরুকে বিলম্বিত করতে বা হয়তো সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে সাহায্য করতে পারে।
কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি ফার্টিলিটি সেন্টারের পরিচালক ড. জেভ উইলিয়ামস মনে করেন, “মেনোপজকে একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়ার পরিবর্তে, একে পরিবর্তনযোগ্য একটি স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা উচিত।
ডিম্বাশয়ের বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ধীর করার জন্য বিভিন্ন ধরনের গবেষণা চলছে।
- এর মধ্যে রয়েছে ওষুধ প্রয়োগ, কোষ প্রকৌশল এবং অস্ত্রোপচার পদ্ধতি।
- ‘গামেটো’ নামক একটি স্টার্টআপ কোম্পানি স্টেম সেল থেকে তৈরি করা ডিম্বাশয়ের সহায়ক কোষ ব্যবহার করে মেনোপজকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে।
- এছাড়াও, ‘সেলম্যাটিক্স’ নামের একটি বায়োটেক ফার্ম এমন একটি ওষুধ তৈরি করছে, যা ডিম্বাশয়ের কর্মক্ষমতা হ্রাসের গতি কমাতে পারে।
- কিছু গবেষক ক্ষতিগ্রস্ত কোষ সরিয়ে ফেলার জন্য সেনোলাইটিক্স নামক ওষুধ নিয়ে কাজ করছেন, যা প্রদাহ এবং রোগের কারণ হতে পারে।
- এছাড়া, কোষের শক্তি বাড়াতে এবং ডিম্বাশয়ের টিস্যু পুনর্গঠনের জন্য স্টেম সেল থেরাপি নিয়েও গবেষণা চলছে।
এই গবেষণাগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন ইয়েল স্কুল অফ মেডিসিনের গবেষক ড. কুটলুক ওক্তায়।
তিনি একটি অস্ত্রোপচার পদ্ধতির মাধ্যমে মেনোপজকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করছেন। এই পদ্ধতিতে, মহিলাদের ডিম্বাশয়ের বাইরের স্তর (কর্টেক্স) থেকে রিজার্ভ ডিম্বাণু (প্রাইমোরডিয়াল ফলিকলস) সংগ্রহ করা হয়।
সাধারণত, এই প্রক্রিয়াটি ৩৫ থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যে করা হয়। এরপর এই টিস্যু জমা করে রাখা হয় এবং পরবর্তীতে, যখন মহিলাদের শরীরে মেনোপজের লক্ষণ দেখা যায়, তখন সেই টিস্যু আবার প্রতিস্থাপন করা হয়।
ড. ওক্তায়ের মতে, এই পদ্ধতিতে প্রায় ৬০ শতাংশ ডিম্বাণু বাঁচে এবং ভবিষ্যতে এই হার আরও বাড়তে পারে।
ড. উইলিয়ামস এবং তার দল মেনোপজ বিলম্বিত করার জন্য ‘র্যাপামাইসিন’ নামক একটি ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করছেন।
এই ওষুধটি বর্তমানে কিডনি প্রতিস্থাপনের পর ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত। গবেষণায় দেখা গেছে, র্যাপামাইসিন ডিম্বাশয়ের বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ধীর করতে পারে, যা ডিম্বাণুর সংখ্যা ও গুণগত মান বজায় রাখতে সাহায্য করে।
ড. উইলিয়ামস আরও জানান, “এই গবেষণা সফল হলে, এটি দ্রুত মানুষের স্বাস্থ্যখাতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারে।
বর্তমানে, তিনি একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে এর কার্যকারিতা যাচাই করছেন। এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারী মহিলারা হয় র্যাপামাইসিন অথবা একটি প্লেসবো গ্রহণ করছেন এবং তাদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
যদি এই গবেষণা সফল হয়, তবে মহিলাদের প্রজনন ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা যেতে পারে।
এর ফলে, সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে সমাজের ধারণা বদলানোরও সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, মেনোপজ বিলম্বিত করার কিছু ঝুঁকিও রয়েছে।
যেমন, শরীরে বেশি সময় ধরে ইস্ট্রোজেন থাকলে স্তন বা জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকি সামান্য বাড়তে পারে।
ড. উইলিয়ামস মনে করেন, এই গবেষণা ডিম্বাশয়ের বার্ধক্যকে সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং দীর্ঘ জীবনের সাথে সম্পর্কিত করে নতুনভাবে দেখার সুযোগ তৈরি করে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মেনোপজকে বিলম্বিত করার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই গবেষণাগুলো সফল হলে, মহিলাদের স্বাস্থ্য এবং জীবনযাত্রায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে।
তবে, এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বাকি আছে।
যেমন, মেনোপজ বিলম্বিত করলে মহিলাদের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি কি প্রভাব পড়বে?
আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে এই গবেষণাগুলোর ফল পাওয়া যাবে এবং মহিলাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক