প্রাচীন মিশরের পিরামিডগুলি কীভাবে তৈরি হয়েছিল? যুগ যুগ ধরে এই প্রশ্নটি মানুষের মনে কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছে। বিশাল এই স্থাপত্যগুলি শুধু মিশরীয়দের প্রকৌশল দক্ষতার প্রমাণই নয়, বরং মানব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
গিজার বিশাল পিরামিডগুলি আজও টিকে আছে, যা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। কীভাবে কয়েক হাজার বছর আগে মানুষ আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়াই এত বড় কাঠামো তৈরি করলো, তা সত্যিই এক রহস্য।
ঐতিহ্যগতভাবে, গ্রিকরা মনে করতো, পিরামিডগুলি নির্মিত হয়েছিল কঠোর শ্রমের মাধ্যমে, যেখানে ক্রীতদাসদের ব্যবহার করা হতো। আবার, আধুনিক কিছু তাত্ত্বিক মনে করেন ভিনগ্রহের প্রাণীরা (aliens) এই পিরামিড তৈরি করেছে।
তবে আসল ঘটনা অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং অনেক সহজ।
আসলে, পিরামিড নির্মাণের পেছনে ছিল মিশরের দক্ষ শ্রমিকদের দল। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, এই শ্রমিকরা কোনো ক্রীতদাস ছিল না, বরং তারা ছিল অত্যন্ত দক্ষ কারিগর।
গিজার গ্রেট পিরামিডের ভিত্তি তৈরি করতে প্রায় ২৬,০০০ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়েছিল। যারা শুধু পাথর কাটার কাজই করতো না, তারা ছিল দক্ষ নাবিকও।
নীল নদ দিয়ে তারা মালপত্র আনা-নেওয়া করতো। শ্রমিকদের থাকার জন্য পিরামিডের কাছেই তৈরি করা হয়েছিল ছোট ছোট শহর। সেখানে ছিল বেকারি, মদের ভান্ডার এবং আরামদায়ক জীবনযাপনের ব্যবস্থা।
এই বিশাল পাথরগুলো কিভাবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেওয়া হতো? পিরামিড তৈরিতে ব্যবহৃত চুনাপাথরের প্রতিটি ব্লকের ওজন ছিল প্রায় ২.৫ থেকে ১৫ টন।
সবচেয়ে ভারী পাথর, যা মিশরের গিজার ফারাও খুফুর সমাধিতে ছিল, তা গ্রানাইট পাথরের তৈরি ছিল, যার ওজন ছিল প্রায় ২৫ থেকে ৮০ টন পর্যন্ত! এই পাথরগুলো প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দূর থেকে, আসওয়ান থেকে আনা হতো।
পাথরগুলি প্রধানত নীল নদ দিয়ে বয়ে আনা হতো। এরপর নদীর কাছাকাছি নির্মাণস্থলে নিয়ে আসার জন্য শ্রমিকরা বিশেষ কৌশল অবলম্বন করত।
তারা অপেক্ষা করত যখন নীল নদের জল আসে, কারণ বর্ষাকালে নদীর জল বেড়ে গেলে নৌকার মাধ্যমে পাথরগুলো সহজে নির্মাণ স্থানে আনা যেত।
পাথরগুলি উপরে তোলার কাজটিও ছিল বেশ কঠিন। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, ঢালু পথ (ramp) এবং পুলির (pulley) ব্যবহারের মাধ্যমে পাথরগুলো উপরে তোলা হতো।
কেউ কেউ মনে করেন, ভার উত্তোলনের জন্য তারা ওজন কমানোর কৌশল ব্যবহার করত।
গ্রেট পিরামিড তৈরি করতে প্রায় ২৬ বছর লেগেছিল। প্রতিটি পাথর তৈরি, পরিবহন এবং বসানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হতো।
এই কারণে, পিরামিডগুলি আজও এত মজবুতভাবে টিকে আছে। নির্মাণের সময় এর উচ্চতা ছিল প্রায় ১৪৬.৬ মিটার (৪৮১ ফুট), যা প্রায় ৩,৮০০ বছর ধরে মানবনির্মিত সবচেয়ে উঁচু কাঠামো ছিল।
বর্তমানে ক্ষয়ক্ষতির কারণে এর উচ্চতা ১৩৭ মিটারে (৪৫০ ফুট) দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু কেন তৈরি করা হয়েছিল এই পিরামিডগুলি? প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল মৃত্যুর পর জীবন আছে।
তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, ফারাওদের মৃত্যুর পর তাদের আত্মার শান্তি এবং পরকালের জীবনের জন্য পিরামিড তৈরি করা হতো। পিরামিডের ভেতরে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, ধনসম্পদ এবং প্রিয়জনদের সমাধিস্থ করা হতো।
প্রাচীন মিশরীয়রা উদ্ভাবনী প্রকৌশল, মানব শক্তি এবং সুসংগঠিত পরিকল্পনার মাধ্যমে পিরামিড তৈরি করেছিল। তারা স্লেজ, ঢালু পথ এবং বিশাল শ্রমিক বাহিনী ব্যবহার করে পাথরগুলো স্থাপন করেছিল।
পিরামিডগুলি তাদের প্রকৌশল দক্ষতা এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তথ্য সূত্র: ট্রাভেল এন্ড লেজার