পুরুষ সাহিত্যিকদের কি সত্যিই এখন প্রয়োজন?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাহিত্য জগতে প্রায়ই একটি প্রশ্ন শোনা যায়: কোথায় গেলেন সাহিত্য জগতের পুরুষ লেখকেরা? আশির দশকের কিংসলে অ্যামিস, ইয়ান ম্যাকইউয়ান, অথবা সালমান রুশদির মতো প্রভাবশালী পুরুষ সাহিত্যিকদের উত্তরসূরি কারা?
এই প্রশ্নটি আবারও জোরালো হয়েছে, যখন লেখক জুড কুক একটি নতুন প্রকাশনা সংস্থা, কন্ডুইট বুকস (Conduit Books) চালু করেছেন। প্রাথমিকভাবে এই প্রকাশনা সংস্থা পুরুষ লেখকদের কাজ প্রকাশের ওপর গুরুত্ব দেবে।
প্রকাশক জুড কুকের মতে, গত ১৫ বছরে প্রকাশনা জগতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। আশির, নব্বই ও দুই হাজারের দশকের পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত সাহিত্যচর্চার প্রতিক্রিয়ায় এই পরিবর্তন দেখা যায়।
এখন প্রকাশনা জগতে তরুণ নারী লেখকদের জয়জয়কার চলছে, যাদের অগ্রভাগে আছেন স্যালি রুনি’র মতো লেখকেরা। যদিও এটিকে একটি ‘সময়োপযোগী সংশোধন’ হিসেবে দেখা হচ্ছে, এর ফলে অনেক সময় পুরুষ লেখকদের কণ্ঠস্বরকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।
তাদের লেখালেখিকে অনেক সময় সমস্যাপূর্ণ হিসেবেও বিবেচনা করা হচ্ছে।
তাহলে, পুরুষ সাহিত্যিকদের কি সত্যিই অবনতি ঘটছে?
কিছু পরিসংখ্যান অন্তত সে কথাই বলে। উদাহরণস্বরূপ, এ বছর সানডে টাইমস-এর (Sunday Times) সেরা বিক্রিত ফিকশন হার্ডব্যাক (fiction hardback) বইগুলোর তালিকায় লেখকদের মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পুরুষ।
তবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণের আরও অনেক উপায় আছে। নারীরা ফিকশন (fiction) তালিকায় আধিপত্য বিস্তার করলেও, গত বছর যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বইয়ের শীর্ষ দুটি স্থান ছিল রিচার্ড অস্মানের (Richard Osman) উপন্যাসের দখলে।
এছাড়া, ২০২৪ সালের বুকার পুরস্কারের (Booker Prize) সংক্ষিপ্ত তালিকায় পাঁচজন নারী লেখকের বিপরীতে ছিলেন মাত্র একজন পুরুষ।
অন্যদিকে, ২০২৩ সালের তালিকায় নারীর চেয়ে ‘পল’ নামের লেখকের সংখ্যা ছিল বেশি!
নন-ফিকশন (non-fiction) বা অ-উপন্যাস বিভাগে চিত্রটা আরও স্পষ্ট।
এ বছর সানডে টাইমস-এর নন-ফিকশন হার্ডব্যাক বেস্টসেলার (bestseller) তালিকায় ৬৩ শতাংশ লেখক পুরুষ, এবং নন-ফিকশন পেপারব্যাক (paperback) তালিকায় ৭০ শতাংশ লেখকের কাজ প্রকাশিত হয়েছে।
জেমস ক্লিয়ারের (James Clear) ‘আটোমিক হ্যাবিট’ (Atomic Habits) বইটির উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যা প্রকাশের কয়েক বছর পরও এখনো বেশ বিক্রি হচ্ছে।
নারী ও পুরুষের এই সাহিত্যিক বিভাজন কতটা উদ্বেগের, তা নিয়ে লেখক, প্রকাশক এবং সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে।
প্রকাশনা সংস্থা সূত্রে জানা যায়, “প্রকাশকদের জন্য পুরুষ লেখকদের তুলে আনা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে।” লেখক নীল মুখার্জি, যিনি ‘দ্য লাইভস অফ আদার্স’ (The Lives of Others)-এর মতো উপন্যাস লিখেছেন, তিনি এই বিষয়ে একমত পোষণ করেন।
তিনি আরও বলেন, পুরুষ লেখকদের সাফল্যের পথ বর্তমানে সংকীর্ণ হয়ে আসছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুরুষ এজেন্ট জানিয়েছেন, বর্তমানে পুরুষ লেখকদের কণ্ঠস্বর, বিশেষ করে মধ্যবয়সী পুরুষদের অভিজ্ঞতা, সেভাবে গ্রাহ্য করা হচ্ছে না।
তিনি মনে করেন, বিনোদন জগতে পুরুষদের যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এবং তাদের নিজেদের জায়গা তৈরি করতে হবে।
অন্যদিকে, ‘আই’ম আ ফ্যান’ (I’m a Fan)-এর লেখক, শিনা প্যাটেল বলেন, “পুরুষরা ভালোই করছেন। তাদের কাজ তৈরি করতে দেওয়া উচিত, এবং তারপর সবাই সিদ্ধান্ত নেবে তা সময় দেওয়ার যোগ্য কিনা।
তারা যেন শিল্পের জগতে নিজেদের সংখ্যালঘু হিসেবে জাহির না করেন।”
অন্যদিকে, শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যিক সংস্থা ম্যাডেলিন মিলবার্নের প্রধান ম্যাডেলিন মিলবার্ন মনে করেন, আমাদের আরও পুরুষ সাহিত্যিকের প্রয়োজন।
তিনি বলেন, “এমন একটা সময় ছিল যখন আমাদের আরও নারী সাহিত্যিকের প্রয়োজন ছিল, বিশেষ করে ক্রাইম (crime) এবং সাসপেন্স (suspense) ঘরানায়। নারী-প্রধান মনোবৈজ্ঞানিক সাসপেন্স এখনো জনপ্রিয়, এটা দেখে আমি আনন্দিত।
তবে ভারসাম্য রক্ষার জন্য উভয় দিকেই মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।” কন্ডুইট বুকস নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে মিলবার্ন আরও যোগ করেন, “পুরুষরা যে ধরনের বই পড়তে চান, সেই ধরনের বইয়ের জন্য আমাদের আরও পুরুষ সম্পাদক দরকার।”
প্রকাশকদের সমিতির সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, প্রকাশনা কর্মীদের মধ্যে ৬৮ শতাংশ নারী।
আরেকজন নারী এজেন্ট মনে করেন, “প্রকাশনার ক্ষেত্রে লিঙ্গের চেয়ে শ্রেণির বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।” এছাড়া, জাতিগত প্রতিনিধিত্বের অভাবও একটি সমস্যা হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
গত সপ্তাহে সেরা ১০ ফিকশন এবং নন-ফিকশন হার্ডব্যাক বেস্টসেলার তালিকায় শুধুমাত্র একজন করে সংখ্যালঘু লেখকের বই ছিল।
ফিকশন বিভাগে ছিলেন চিমানন্দা এনগোজি আদিচি, এবং নন-ফিকশন বিভাগে রক্সি নাফৌসি।
লুক ব্রাউন, যিনি ‘মাই বিগেস্ট লাই’ (My Biggest Lie) এবং ‘থেফট’ (Theft)-এর মতো বই লিখেছেন, তিনি বলেন, “আমি আমার প্রজন্মের অনেক শ্রমিক শ্রেণির পুরুষকে চিনি, যারা তাদের নিজেদের জগৎ খুঁজে পেয়েছিলেন ইভাইন ওয়েলশের (Irvine Welsh) মতো লেখকদের লেখায়।”
ওয়েলশ নিজেও মনে করেন, পুরুষদের লেখা শুরু করার আগে পড়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, “পুরুষরা ইন্টারনেট-এর ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, তাই তারা হয়তো কম বুদ্ধিমান হয়ে উঠছে।
অন্যদিকে, মহিলারা বেশি বই পড়ছেন, তাই তারা আরও জ্ঞানী হচ্ছেন।”
কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন, পুরুষ সাহিত্যিকদের কাজ প্রকাশের ক্ষেত্রে আগ্রহ কমার কারণ হলো পুরুষদের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতা কমে যাওয়া।
২০২৩ সালে, যুক্তরাজ্যে ফিকশন বইয়ের ৩৭ শতাংশ কিনেছেন পুরুষরা।
নারীরা সামগ্রিকভাবে বেশি বই কিনলেও (গত বছর মোট বইয়ের ৫৮ শতাংশ), পুরুষরা নন-ফিকশন বই বেশি কেনেন (৫৫ শতাংশ)।
ব্রাউন যোগ করেন, “পুরুষদের উচিত নারীদের লেখা পড়া এবং নারীদেরও পুরুষদের লেখা পড়া উচিত। এর মাধ্যমে আমরা একে অপরের সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারব।”
জুড কুকের এই নতুন উদ্যোগের সমালোচনাও হয়েছে।
তবে নীল মুখার্জি বলেছেন, এই প্রকল্পের ভিত্তি ‘ফারাজ-পন্থী ক্ষোভ’ বা ‘নারীবিদ্বেষী হট্টগোলের’ বিপরীত।
তিনি আরও যোগ করেন, “এ নিয়ে নিঃসন্দেহে অনেক সমালোচনা হবে। কিন্তু লেখালেখি ও প্রকাশনা কোনো শূন্য-সমষ্টির খেলা নয়।”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান