ভাইয়ের খোঁজে: বাবার ভুলের কি ক্ষমা নেই?

মার্চ মাসের এক সকালে, ১৯৯৫ সালে, বাবার সাথে বসে কফি খাচ্ছিলাম। কথার মাঝেই প্রসঙ্গক্রমে এলো আমার দাদা, মার্শাল-এর কথা।

আমার এখনো মনে আছে, বাবার চোখে কেমন একটা বিষণ্ণতা ফুটে উঠেছিল। “ছেলেটা দেখতে লম্বা ছিল,” বাবা বললেন, যেন মার্শাল তখনো আমাদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।

“স্কুলে সবাই ওকে ফুটবল দলে নিতে চাইত। চুলগুলো ছিল লাল, একদম আমার মায়ের মতো, আর চোখ…” বাবা একটু থেমে, যেন সঠিক উপমা খুঁজছেন। “তামা রঙের।

গরমকালে এমন রং ধরত যে দেখলে মনে হতো কাঠের বার্নিশ করা হয়েছে।” বাবা হাসতে হাসতে বললেন, “মার্শাল যখন ১৭ বছরে, একটা ছোট গল্প লিখে হার্ভার্ডে স্কলারশিপ পেয়েছিল, আর সে সেটা প্রত্যাখ্যান করলো!

ভাবা যায়?” বাবার কণ্ঠে হতাশা, যেন সুযোগটা হাতছাড়া হওয়ার ক্ষোভ এখনো টাটকা। “ছেলেটা ছিল দারুণ লেখক।” বাবার প্রজন্ম এমন একটা ধারণায় বিশ্বাসী ছিল যে হার্ভার্ডের মতো জায়গা থেকে ডাক পেলে, তা প্রত্যাখ্যান করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

আমি বাবাকে বললাম, “হয়তো মার্শাল সেই সময়ে ওই সুযোগটা নিতে চায়নি। হয়তো এটাই সঠিক সময় ছিল না।” আমার কথা শেষ না হতেই বাবার গলায় বিরক্তি, “তারপর সে হিপ্পি হয়ে গেল।”

আমি ছোটবেলা থেকেই পরিবারের কাছ থেকে মার্শাল সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। বাবা শেষবার মার্শালকে দেখেছিলেন ২২ বছর আগে।

মার্শাল তখন ভবঘুরে, হিপ্পি। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে টেক্সাস পর্যন্ত সে এসেছিল, টাকার খুব দরকার ছিল তার।

আমার বাবা ৫৪ বছর বয়সে আমার জন্ম দিয়েছেন, আর আমি তাকে খুব ভালোবাসতাম। তার কণ্ঠ ছিল উষ্ণ, আর তিনি ছিলেন বুদ্ধিমান ও আকর্ষণীয়।

যখন আমার বয়স চার বছর, আমি জানতে চেয়েছিলাম, কেন আমার নাভি আছে। তিনি বলেছিলেন, এটা স্যালাড খাওয়ার সময় ডুব দেওয়ার জন্য!

আমার আর আমার বোনের জন্য আপেল গাছের ডালে চকলেট ডাইজেস্টিভ বিস্কুট লুকিয়ে রাখতেন তিনি, আর আমরা সেগুলো কুড়ানোর জন্য বাবার কাঁধে চড়ে বসতাম, যেন সত্যি সত্যিই গাছ থেকে বিস্কুট পাওয়া যায়!

তবে বড় হওয়ার পরে, আমি জানতে চাইলাম, আমার জন্মের আগে বাবার জীবন কেমন ছিল। বাবার এক ছেলের জীবন এভাবে শেষ হয়ে যাওয়াটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না।

বাবার সিদ্ধান্ত ছিল, নাকি মার্শালের? আমার ভাই কীভাবে চার্লস ম্যানসনের কুখ্যাত দলে যোগ দিল, যে ঘটনা আমেরিকার সমাজে আলোড়ন তুলেছিল?

বহু বছর ধরে গবেষণা এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলার পরে, আমি ধীরে ধীরে কিছু উত্তর খুঁজে পেয়েছি।

মার্শালের গল্প শুরু হয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়ার রোদ ঝলমলে দিন, প্রেম আর সাম্যবাদের ধারণার অনেক আগে, ১৯৫০-এর দশকে মিশিগানের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে।

মার্শালের মা, আমার বাবার প্রথম স্ত্রী, স্যালি মানসিক রোগে ভুগছিলেন।

১৯৫৪ সালে, দীর্ঘদিন মানসিক অসুস্থতায় ভোগার পর, স্যালিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি এবং ওষুধ গ্রহণ করেন।

বাড়ি ফেরার অনুমতি পাওয়ার কয়েকদিন পরই তিনি ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তখন মার্শালের বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর।

এই ভয়াবহ ঘটনার পর, বাবা আমার ঠাকুরমার সাহায্যে মার্শালকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তিনি মার্শালকে ইন্ডিয়ানার একটি সামরিক একাডেমি, “হাওয়ে স্কুলে” ভর্তি করেন।

সেখানে তোলা একটি ছবিতে দেখা যায়, ১৩ বছর বয়সী মার্শাল স্কুলের গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখে গভীর কষ্ট।

কিন্তু হাওয়ে স্কুলে মার্শালের বেশি দিন ভালো লাগেনি। বাবার চাকরির সূত্রে তারা নেদারল্যান্ডসে চলে যান, যেখানে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন।

ততদিনে মার্শালের বয়স ১৫ বছর। তার আচরণে অস্থিরতা দেখা দেয়। আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, গভীর মানসিক আঘাত পেলে মানুষ বিভিন্ন উপায়ে তা প্রকাশ করে, আর এক্ষেত্রে আচরণই ছিল প্রধান উপায়।

১৯৫৯ সালে মার্শালকে সুইজারল্যান্ডের একটি বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয়।

১৯৬২ সালে, ১৮ বছর বয়সে, মার্শাল ভিয়েতনামে যোগ দেন। সেখানে যুদ্ধের ভয়াবহতা তার জীবন বদলে দেয়।

একটি বিস্ফোরণে তার মাথার একদিকে ক্ষত হয় এবং ডান কানে গুরুতর আঘাত লাগে। শারীরিক আঘাতের চেয়ে মানসিক ক্ষত ছিল আরও গভীর।

১৯৬৬ সালে, মার্শাল যখন বাড়ি ফেরে, তখন আমেরিকার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। তরুণ যোদ্ধাদের আত্মত্যাগের প্রতি অনেকেরই কোনো সম্মান ছিল না।

এমন একটা সময়ে, মার্শালসহ আরও অনেকে তাদের জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে ফিরছিল। ২৩ বছর বয়সে, মার্শাল হিপ্পি জগতে প্রবেশ করে, যেখানে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন চলছিল।

সনাতন মূল্যবোধ ভেঙে পড়ছিল, আর সেই সুযোগে চার্লস ম্যানসনের মতো কুখ্যাত ব্যক্তিরা দুর্বল মানুষদের আকৃষ্ট করতে শুরু করে।

স্প্যান র‍্যাঞ্চ ছিল ম্যানসনের গুরু হওয়ার উপযুক্ত জায়গা।

এখানে সমাজের কোনো নিয়ম-কানুন ছিল না, এবং এখানকার সদস্যরা একটা গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন যাপন করত। প্রথমে, মার্শাল হয়তো ছোটখাটো কাজে অংশ নিত, ধীরে ধীরে সে এই দলের সঙ্গে মিশে যায়।

কিন্তু নয় মাস পরেই সব ওলটপালট হয়ে যায়।

ম্যানসনের হত্যাকাণ্ডের পর তার আসল রূপ প্রকাশ পায়। মার্শালের মানসিকতা ছিল দৃঢ়, তাই সে দল ছেড়ে চলে যায়।

১৯৭৩ সালে, ম্যানসন এবং তার সঙ্গীদের কারাদণ্ডের দুই বছর পর, মার্শালের সাথে বাবার শেষ দেখা হয়।

মার্শাল তখন ২৯ বছরের যুবক। টেক্সাসের হিউস্টনে বাবার বাড়ির দরজায় এসে হাজির হয় সে।

গরমে তার পরনে কোনো জামা ছিল না, পরনে ডেনিমের পোশাক, পায়ে জুতো নেই। তার রুক্ষ চুলের ফাঁকে পরিচিত তাম্রবর্ণের চোখ জ্বলজ্বল করছিল।

বাবা তাকে দেখে খুশি হয়েছিলেন।

মার্শালকে সাদরে গ্রহণ করা হলো। বাবা তাকে আমার মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং তার নতুন কন্যাকে দেখালেন।

মার্শাল কয়েক দিন ছিল, আর মা বলেন, আমার ছোট বোনের প্রতি সে খুবই স্নেহশীল ছিল।

এক সপ্তাহ পর, সে চলে যাওয়ার কথা জানায়।

বাবার কর্পোরেট চাকরি নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ হয়। মার্শাল বাবার রক্ষণশীল জীবনযাত্রাকে মেনে নিতে পারেনি।

তাদের মধ্যে তীব্র তর্ক হয়।

মার্শাল তার বাবাকে ‘কর্পোরেট জারজ’ বলেছিল।

মার্শাল বলেছিল, “এটাই আমার জীবন, আর আমি এভাবেই বাঁচব।”

বাস স্টেশনের দিকে যাওয়ার পথে, মার্শাল গাড়ি থেকে নামতে চাইল।

বাবার গাড়ি চলে যাওয়ার পর, তিনি দেখলেন একটি ভ্যান এসে থামল। তার ছেলে সেই গাড়িতে উঠল।

১৯৮১ সালের আগস্ট মাস। এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায়, আমি এবং আমার বোন বাগানে খেলছিলাম।

এমন সময় বাবার কাছে একটা ফোন আসে।

ফোনের ওপাশ থেকে মার্শাল নামের কেউ একজন, যে কিনা সাহায্যের জন্য আকুল আবেদন জানাচ্ছিল।

১৯৮০-এর দশকে, চার্লস ম্যানসনের সাথে জড়িত সন্দেহে অনেকের তদন্ত চলছিল।

মার্শালও সেই তালিকায় ছিল। ম্যানসন হত্যাকাণ্ডের ছায়া তখনও কাটেনি।

কিন্তু এরপর মার্শাল সম্পর্কিত সব আলোচনা যেন হঠাৎ করেই থেমে গেল।

২০০২ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর। সেদিন ছিল ৯/১১ হামলার প্রথম বার্ষিকী।

আমি এবং আমার স্বামী লন্ডনে আমাদের স্টুডিও ফ্ল্যাটে বসে টিভিতে খবর দেখছিলাম।

এই ঘটনার পর বিশ্বজুড়ে যে ভীতি তৈরি হয়েছিল, তা যেন আমার বাবার দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি ছিল।

এই বছরই তার ৮০ বছর বয়স হবে। তাই আমি তার অতীত সম্পর্কে কিছু অজানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করি।

বছরজুড়ে মার্শালের কথা আমার মনে ছিল।

তার ছবি খুঁজে পাওয়া যেত, অথবা কোনো কথোপকথনে তার কথা উঠত।

২০০৩ সালের আগস্টে, আমি একটি অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ‘মাইস্পেস’-এ অ্যাকাউন্ট খুললাম।

সেখান থেকে আমার হারিয়ে যাওয়া ভাইকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।

আমার অনুসন্ধানে অনেক ‘মার্শাল পটার’-এর সন্ধান পাওয়া গেলেও, তাদের কেউই আমার ভাই ছিল না।

এরপর আমি সরকারি নথিপত্র ও আদমশুমারির তথ্য খুঁজতে শুরু করি। অবশেষে, আমি আমার ভাইয়ের সন্ধান পাই।

তার জন্ম তারিখ মিলে গিয়েছিল, কিন্তু সেখানে আরেকটি তারিখ ছিল: ১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫।

আমি বুঝতে পারলাম, আমার ভাই আত্মহত্যা করেছে।

প্রায় এক মাস পর, পোস্টম্যান একটি খাম দিয়ে গেল, যেখানে আমার স্বাক্ষর করার কথা ছিল।

খামটি হাতে নেওয়ার পর, আমার মধ্যে এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল। আমি যেন জানতে পারছিলাম, আমার ভাইয়ের মৃত্যুর কারণ।

সার্টিফিকেটটিতে লেখা ছিল, মৃত্যুর কারণ: মাথায় গুলি, আত্মহত্যা।

আমি প্রায়ই বাবার সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে ভাবি।

তিনি কি তার সময়ের শিকার ছিলেন? মার্শাল কি তার বাবার ভুলের ফল?

আমার এখনো মনে হয়, আমার বাবা কেন তার ছেলেকে এভাবে একা ছেড়ে দিলেন।

২০০৭ সালে যখন বাবার মৃত্যু হয়, তখন আমি শুধু তাকেই হারাইনি, মার্শালের স্মৃতিও আমার মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে।

আমার বাবা ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পাননি, আর আমি নিশ্চিত, তিনি হয়তো এ নিয়ে অনুশোচনা করতেন।

আজকের ডিজিটাল যুগে, যখন আমাদের শিশুরা ক্ষতিকর প্রভাবকদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, তখন আমার বাবা ও মার্শালের গল্প আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।

আমাদের শিশুদের সঙ্গে কথা বলা, তাদের বুঝতে পারাটা খুব জরুরি।

একজন অভিভাবক হিসেবে আমি সেই দায়িত্ব পালন করব, কারণ আমি জানি, এর অন্যথা হলে পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে।

তথ্য সূত্র: The Guardian

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *