লেসবস দ্বীপ: শরণার্থী স্রোত, মানবিকতা ও ইউরোপের সীমান্তনীতি
ভূমধ্যসাগরের একটি দ্বীপ, লেসবস। তুরস্কের কাছাকাছি অবস্থিত এই গ্রিক দ্বীপটি একসময় পরিচিত ছিল আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে। কয়েক দশক আগেও, এই দ্বীপে গ্রিক-তুর্কি যুদ্ধের সময় বিতাড়িত হয়ে আসা মানুষের আনাগোনা ছিল।
সময়ের সাথে সাথে যেন সেই স্মৃতি ফিকে হয়ে আসছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে, এক ভয়াবহ শরণার্থী সংকটের সাক্ষী হয় লেসবস। যুদ্ধ এবং অস্থিরতা থেকে বাঁচতে আসা মানুষের ঢল নামে এখানে। তাদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় বাসিন্দাদের মানবিকতা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছিল।
কিন্তু সময়ের সাথে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত নীতিতে পরিবর্তনের কারণে আশ্রয়প্রার্থীদের জীবন কঠিন হয়ে পড়ে। শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার পরিবর্তে তাদের আটকের ব্যবস্থা করা হয়। “নিরাপদ তৃতীয় দেশ” ধারণার অধীনে তুরস্ককে শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর চুক্তি হয়। এই চুক্তির ফলে মানবিকতার বদলে কঠোর নীতি গ্রহণ করা হয়, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পরিপন্থী ছিল।
লেসবসে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য নির্মিত হয় মোরিয়া শরণার্থী শিবির। শুরুতে এটি ছোট একটি কেন্দ্র হিসেবে তৈরি করা হলেও, শরণার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় এটি ধারণক্ষমতার বাইরে চলে যায়। আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব দেখা দেয়, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটে।
শরণার্থীদের আগমনকে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। মানবিক সহায়তা প্রদানকারীদের উপর দুর্নীতির অভিযোগ আনা হতে থাকে। শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়াটা যেন অপরাধের পর্যায়ে চলে যায়। সমাজের মধ্যে তৈরি হয় বিদ্বেষ, যা মানবিকতার ধারণাকে দুর্বল করে দেয়।
২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে, লেসবসের পশ্চিম উপকূলে একটি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় স্থানীয় মানুষজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শরণার্থীদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে। যদিও অনেকের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়নি। মৃতদেহগুলো তীরে ভেসে আসতে থাকে। তখনো মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখা গিয়েছিল।
তবে, সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে ওঠে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন নীতিমালার কারণে শরণার্থী শিবিরগুলোতে মানুষের দুর্দশা বাড়তে থাকে। সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ এবং মাঝে মাঝে সহিংসতার ঘটনাও ঘটে। শরণার্থীদের হুমকি হিসেবে চিত্রিত করা হতে থাকে এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোকে ভুল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
২০১৬ সালের অক্টোবরে, মোরিয়া শরণার্থী শিবিরে গিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়। সেখানে থাকা মানুষের জীবনযাত্রার মান ছিল অত্যন্ত নিচু। পর্যাপ্ত খাবার, পানি বা স্বাস্থ্যবিধির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এর মাঝেও শরণার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব ছিল চোখে পড়ার মতো।
শরণার্থী সংকট এবং মানবিকতার এই কঠিন সময়ে, কিছু মানুষের মধ্যে এখনো সহানুভূতি ও সহমর্মিতার দৃষ্টান্ত দেখা যায়। এটি প্রমাণ করে, প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও মানুষ হিসেবে আমাদের কর্তব্যগুলো ভোলা উচিত নয়। শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের প্রতি মানবিক আচরণ করাটা জরুরি।
সম্প্রতি, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা, শরণার্থী সহায়তা বিষয়ক সংগঠন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মিলে একটি যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো শরণার্থীদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর গুরুত্ব তুলে ধরা এবং তাদের প্রতি হওয়া বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই করা। এই ধরনের উদ্যোগগুলো সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়তা করবে।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা