আপনি কি নিজেকে লুকিয়ে রাখেন? আসল ইচ্ছেরা কোথায়?

নিজের ভালো লাগা আর অন্যের প্রত্যাশা – এই দুইয়ের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করাটা সবসময় সহজ হয় না। সমাজের চোখে ভালো মানুষ হতে গিয়ে অনেক সময় আমরা নিজেদের চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব দিতে ভুলে যাই।

এই প্রবণতা, অর্থাৎ সবাইকে খুশি করার চেষ্টা, মনোবিজ্ঞানের ভাষায় ‘পিপল-প্লীজিং’ নামে পরিচিত। আমাদের সমাজে এর প্রভাব বেশ গভীর। আসুন, এই বিষয়ে কিছু কথা বলি।

‘পিপল-প্লীজিং’ মানে হল, অন্যদের খুশি করার জন্য নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করা। এর মূল কারণ হতে পারে, সামাজিক স্বীকৃতি লাভের আকাঙ্ক্ষা অথবা ভালোবাসার অভাব।

ছোটবেলা থেকে আমরা হয়তো এমন পরিবেশে বড় হই, যেখানে ভালো থাকার সংজ্ঞাটাই তৈরি হয় অন্যদের প্রত্যাশা পূরণের মাধ্যমে। পরীক্ষায় ভালো ফল করা, গুরুজনদের কথা শোনা—এগুলো আমাদের কাছে সাফল্যের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে আমরা বুঝতে শুরু করি, অন্যদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারলেই কেবল আমরা গ্রহণযোগ্য হব।

নিজের ভেতরের আসল মানুষটিকে তখন যেন কোথাও লুকিয়ে রাখতে হয়।

কিন্তু এই ‘পিপল-প্লীজিং’-এর ফল সবসময় সুখকর হয় না। অতিরিক্ত তোষামোদ করতে গিয়ে অনেক সময় আমরা নিজেদের আত্মমর্যাদাকে খাটো করি।

নিজের ভালো লাগা, নিজের প্রয়োজনগুলো চাপা পড়ে যায়। একসময় আমরা হতাশ হয়ে পড়ি, কারণ নিজের ভেতরের শূন্যতা পূরণ করার মতো কিছু খুঁজে পাই না। মনোবিজ্ঞানী ডোনাল্ড উইনিকটের মতে, শৈশবে যদি কোনো শিশু তার প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো, যেমন—ক্ষুধা, রাগ, অথবা কষ্টের অনুভূতি, প্রকাশ করতে না পারে, তবে তার মধ্যে ‘ফলস সেলফ’ বা মিথ্যা সত্তা তৈরি হতে পারে।

এই মিথ্যা সত্তা তখন আসল সত্তাকে ঢেকে দেয়, এবং ব্যক্তি ধীরে ধীরে অন্যদের প্রত্যাশা অনুযায়ী নিজেকে তৈরি করতে থাকে।

আমাদের সমাজে, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে, এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার কারণে, ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের শেখানো হয়—নম্র, শান্ত ও অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে।

ফলস্বরূপ, তারা নিজেদের ইচ্ছার থেকে বেশি গুরুত্ব দেয় অন্যের মতামতকে। কর্মক্ষেত্রে, পরিবারে, এমনকি বন্ধুদের সঙ্গেও তারা নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করে।

তাহলে, এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী? সবার প্রথমে, নিজেকে ভালোভাবে জানতে হবে। নিজের দুর্বলতাগুলো স্বীকার করতে হবে, সেই সাথে নিজের ভালো দিকগুলোকেও খুঁজে বের করতে হবে। নিজের অনুভূতিগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং সেগুলোকে প্রকাশ করার সাহস রাখতে হবে।

‘না’ বলতে শেখাটা খুব জরুরি। নিজের সীমানা নির্ধারণ করতে পারাটাও প্রয়োজন। প্রয়োজনে, একজন অভিজ্ঞ মনোবিদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।

মনে রাখতে হবে, সবার মন জুগিয়ে চলা সম্ভব নয়। সবার প্রত্যাশা পূরণ করতে গিয়ে নিজের জীবনকে উপভোগ করা যায় না। বরং, নিজের ভালো লাগাগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে, নিজের ভেতরের মানুষটাকে খুঁজে বের করাই আসল সাফল্যের চাবিকাঠি।

আসুন, আমরা সবাই নিজেদের ভেতরের মানুষটাকে ভালোবাসতে শিখি, এবং অন্যদের থেকেও নিজেদের জন্য আরও বেশি কিছু প্রত্যাশা করি।

তথ্য সূত্র: The Guardian

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *