গাজায় সামরিক অভিযান আরও বাড়াচ্ছে ইসরায়েল, লক্ষ্য ‘দীর্ঘমেয়াদী উপস্থিতি’। গাজা উপত্যকায় তাদের সামরিক কার্যক্রম আরও জোরদার করার পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল।
আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই অঞ্চলে তারা তাদের অভিযান আরও বিস্তৃত করবে এবং এর মাধ্যমে তারা সেখানে ‘দীর্ঘমেয়াদী উপস্থিতি’ নিশ্চিত করতে চায়।
ইসরায়েলের নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনাটি ফিলিস্তিনের এই অঞ্চলের জন্য ইসরায়েলের আগের নেওয়া পদক্ষেপগুলো থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে এবং আন্তর্জাতিক মহলে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই নতুন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গাজায় একটি নতুন এবং তীব্র আক্রমণ চালানো হবে।
এর মূল উদ্দেশ্য হলো ‘গাজা জয় করা এবং সেখানকার ভূমি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া’। একই সঙ্গে গাজার সাধারণ মানুষকে তাদের সুরক্ষার জন্য দক্ষিণ দিকে সরিয়ে নেওয়া হবে। হামাসের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে একটি ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই ইসরায়েল গাজায় বোমা বর্ষণ শুরু করে।
এরপর তারা গাজার চারপাশে কয়েক কিলোমিটার গভীর ‘বাফার জোন’ তৈরি করে এবং উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়।
বর্তমানে গাজার ৭০ শতাংশেরও বেশি এলাকা ইসরায়েলের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অথবা ইসরায়েলের দেওয়া নির্দেশের আওতায় রয়েছে, যেখানে ফিলিস্তিনিদের এলাকা ছাড়তে বলা হয়েছে।
রবিবার, ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়ায়েল জামির ঘোষণা করেন, নতুন এই অভিযানের জন্য ‘হাজার হাজার’ রিজার্ভ সেনা সদস্যকে ডাকা হচ্ছে, যাতে নিয়মিত সেনাদের গাজায় মোতায়েন করা যায়।
যদিও কিছু ইসরায়েলি মন্ত্রী গাজায় ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেওয়ার কথা বলেছিলেন, কিন্তু জেনারেল জামির সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন।
উল্লেখ্য, গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজার প্রায় ২৩ লাখ মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগছে এবং মানবিক পরিস্থিতি একেবারে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মন্ত্রীদের ধারণা, বর্তমানে গাজায় ‘পর্যাপ্ত খাদ্য’ মজুত রয়েছে।
তবে, হামাস যেন এই ত্রাণ সামগ্রীর নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে এবং তাদের ক্ষমতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে মানবিক সহায়তা বিতরণের অনুমতি দেওয়া হবে।
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া অবরোধ এবং বোমা হামলার মূল উদ্দেশ্য হলো হামাসকে জিম্মিদের মুক্তি দিতে বাধ্য করা।
হামাসের হাতে এখনো ৫৮ জন জিম্মি রয়েছে, যাদেরকে তারা গত অক্টোবর মাসে ইসরায়েলে চালানো এক হামলায় বন্দী করেছিল।
ওই হামলায় বেশিরভাগ বেসামরিক নাগরিকসহ প্রায় ১,২০০ জন নিহত হয়।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক সামরিক হামলায় এ পর্যন্ত অন্তত ৫২,৫৩৫ জন নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছেন।
ট্রাম্পের ওই প্রস্তাবে গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের জর্ডান বা মিশরের মতো প্রতিবেশী দেশে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যাতে গাজার পুনর্গঠন করা যায়।
ট্রাম্পের আসন্ন সৌদি আরব, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের কারণে ইসরায়েল নতুন করে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে এবং গাজায় ত্রাণ সরবরাহ করতে রাজি হতে পারে।
ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, তিনি চান নেতানিয়াহু ‘গাজার প্রতি সদয়’ হোন।
সফরকালে তিনি সম্ভবত তাঁর অতিথিদের চাপ দেবেন, যাতে ইসরায়েল এই সংকট সমাধানে কিছু ছাড় দেয়।
ইসরায়েলের সামরিক কর্মকর্তাদের মতে, ভূমি দখল তাদের হামাসের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সুবিধা এনে দেবে।
কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন, নতুন এই অভিযানের ঘোষণা এবং গাজায় দীর্ঘমেয়াদী উপস্থিতির পরিকল্পনা মূলত নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তির আলোচনায় সুবিধা পাওয়ার উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইতোমধ্যেই ইসরায়েলের এই পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করেছে।
তারা বলছে, ইসরায়েল যদি গাজায় সীমিত সংখ্যক সহায়তা বিতরণ কেন্দ্র তৈরি করে এবং সেখানে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বেসরকারি ঠিকাদারদের মাধ্যমে ত্রাণ সরবরাহ করতে চায়, তবে তা মানবিক নীতিমালার পরিপন্থী হবে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সমন্বয় কার্যালয় (ইউএন ওচা) রবিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জাতিসংঘের বিদ্যমান ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থা বন্ধ করতে চাইছে এবং তাদের মাধ্যমে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের শর্ত অনুযায়ী ত্রাণ সরবরাহ করতে চাইছে।
এটি একটি বিপজ্জনক পদক্ষেপ, যা বেসামরিক নাগরিকদের সামরিক অঞ্চলে টেনে আনবে এবং তাদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলবে।
হামাস সোমবার এক বিবৃতিতে বলেছে, গাজায় ত্রাণ বিতরণের জন্য ইসরায়েলের নতুন কাঠামো ‘রাজনৈতিক ব্ল্যাকমেইল’-এর সামিল।
তারা গাজার মানবিক বিপর্যয়ের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে।
হামাসের হাতে জিম্মি হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের একটি জোট নেতানিয়াহুকে তাঁদের স্বজনদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলার জন্য অভিযুক্ত করেছে।
তারা বলেছে, ‘সামরিক অভিযানের विस्तारের ফলে প্রতিটি জিম্মির জীবন মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। এটি আমাদের সৈন্যদের জীবনকেও হুমকির মুখে ফেলছে এবং অসংখ্য ইসরায়েলি পরিবারের দুঃখ আরও গভীর করছে।’
নেতানিয়াহুর সরকার, যা তাঁর ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য চরম ডানপন্থী দলগুলোর সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল, দীর্ঘদিন ধরে গাজাকে পুনরায় দখল ও সেখানে বসতি স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছে।
সোমবার নতুন পার্লামেন্ট অধিবেশন শুরু হয়েছে।
ইসরায়েলি বিমান হামলা এখনো চলছে।
হাসপাতালের কর্মীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সোমবার রাতের হামলায় গাজার উত্তরে অন্তত ১৭ জন নিহত হয়েছে।
আল-শিফা হাসপাতালের কর্মীরা জানিয়েছেন, গাজা শহর, বেইত হানুন এবং বেইত লাহিয়ায় হামলায় আটজন নারী ও শিশুসহ বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে।
তথ্য সূত্র: The Guardian