ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ: কানাডার কাছে হার! মার্ক কার্নির সাথে কি আলোচনা?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ এখন নতুন মোড় নিয়েছে। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক নীতি এবং এর প্রতিক্রিয়ায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি এবং ট্রাম্পের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের দিকে এখন সবার দৃষ্টি।

কানাডা, আমেরিকার অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার এবং নিরাপত্তা থেকে শুরু করে বাণিজ্যের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ মিত্র। কিন্তু ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক শুল্ক আরোপের ফলে সেই দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

গত সপ্তাহে কানাডার নির্বাচনে কার্নি’র নেতৃত্বে লিবারেল পার্টির জয় হয়, যা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে নতুন সরকারের একটি কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনের পর কার্নি বলেন, “আমরা আমেরিকার বিশ্বাসঘাতকতার আঘাত থেকে সেরে উঠেছি, তবে আমাদের শিক্ষাগুলো কখনোই ভোলা উচিত নয়।”

আগে, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বিদ্যমান ছিল, কিন্তু ট্রাম্পের শুল্ক নীতি সেই সম্পর্ককে নতুন দিকে মোড় দিয়েছে। এর ফলস্বরূপ, উভয় দেশের অর্থনীতিতেই বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।

ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত, দেশ দুটি ইউনাইটেড স্টেটস-মেক্সিকো-কানাডা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (USMCA) মাধ্যমে আবদ্ধ ছিল। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে এই চুক্তিটি হয়েছিল, যা এক চতুর্থাংশ শতাব্দীর পুরনো উত্তর আমেরিকান মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (NAFTA)-এর স্থলাভিষিক্ত হয়।

তবে চলতি বছর ট্রাম্প পরিস্থিতি পরিবর্তন করেন। মার্চ মাসের শুরুতে, মেক্সিকো ও কানাডার পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল, যা পরে মাদক ও অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধের শর্তে স্থগিত করা হয়। কিন্তু USMCA মেনে চলে না এমন মেক্সিকো ও কানাডার পণ্যগুলোর ওপর এখনো ২৫% শুল্ক বহাল রয়েছে।

এছাড়াও, ট্রাম্প সম্প্রতি গাড়ি, ইস্পাত এবং অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ২৫% শুল্ক ঘোষণা করেছেন, যা অটো যন্ত্রাংশকেও প্রভাবিত করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায়, কানাডা প্রায় ৩০ বিলিয়ন কানাডীয় ডলার (প্রায় ২.৪ ট্রিলিয়ন বাংলাদেশী টাকা) মূল্যের মার্কিন পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করেছে।

এছাড়া, ট্রাম্পের ধাতু বিষয়ক শুল্কের প্রতিক্রিয়ায় কানাডা আরও ২৯.৮ বিলিয়ন কানাডীয় ডলার (প্রায় ২.৩ ট্রিলিয়ন বাংলাদেশী টাকা) মূল্যের পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক বসিয়েছে।

এই বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে উভয় দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে। সরকারি তথ্য অনুসারে, কানাডা মোট বাণিজ্যের ১৪% এর জন্য দায়ী। যুক্তরাষ্ট্র কানাডার শীর্ষ রপ্তানি গন্তব্য, যেখানে তারা বছরে প্রায় ৩৪৯.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৩৭ লাখ কোটি বাংলাদেশী টাকা) মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে, যার মধ্যে প্রধান হলো শক্তি এবং গাড়ি।

অন্যদিকে, কানাডার পণ্য রপ্তানির প্রধান গন্তব্যও যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে তারা তাদের মোট রপ্তানির ৭৫% এর বেশি পাঠায়, যার মধ্যে কাঠ, ইস্পাত এবং অ্যালুমিনিয়াম অন্যতম।

ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ আমেরিকান ব্যবসাগুলোর ওপর প্রভাব ফেলেছে। জেনারেল মোটরস (General Motors)-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেরি বারার মতে, শুল্কের কারণে তার কোম্পানির ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৪২ হাজার থেকে ৫৩ হাজার কোটি বাংলাদেশী টাকা) ক্ষতি হবে।

অন্যদিকে, বেবি পণ্যের নির্মাতা কোম্পানি ‘বিজি বেবি’র মালিক বেথ ফিনবো বেনিকে জানিয়েছেন, তার পণ্যের একটি কন্টেইনার এখন যুক্তরাষ্ট্রে আনতে প্রায় ২ লক্ষ ৩০ হাজার ডলার (প্রায় ২ কোটি ৪৩ লক্ষ টাকা) খরচ হবে।

ফেডারেল রিজার্ভের ‘বেইজ বুক’ নামক প্রতিবেদনে জানা যায়, অনেক আমেরিকান ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কানাডিয়ান পর্যটকদের সংখ্যা হ্রাসের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “উত্তরের ওয়াশিংটন এবং দক্ষিণের ক্যালিফোর্নিয়ার কিছু খুচরা বিক্রেতা এবং আতিথেয়তা প্রদানকারী কানাডা ও মেক্সিকোর সীমান্ত বাণিজ্য পর্যটনে উল্লেখযোগ্য পতন লক্ষ্য করেছেন।”

কানাডিয়ানরাও এখন আমেরিকান পণ্য কেনা থেকে বিরত থাকছেন। ক্যালিফোর্নিয়ার টমেটোর পরিবর্তে তারা ইতালীয় টমেটো, ওহাইওতে তৈরি পেপারোনির বদলে অন্টারিও ও কুইবেকে উৎপাদিত মাংস এবং কোকা-কোলার পরিবর্তে কানাডিয়ান ম্যাপেল সিরাপ দিয়ে তৈরি স্পার্কলিং ওয়াটার পছন্দ করছেন।

টরন্টোোর বাসিন্দা এবং ‘মেড ইন কানাডা’ নামক অনলাইন ডিরেক্টরির পরিচালক ডিলান লোবো বলেন, “আমরা, কানাডিয়ানরা, ঝগড়া তৈরি করতে চাই না। এটা কানাডার ওপর একটি আক্রমণ।”

এই বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে সরবরাহ শৃঙ্খলে পরিবর্তন আসতে পারে এবং বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বাণিজ্য নীতি নির্ধারণে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *