আতঙ্কের জীবাণু: ভয়াবহ ছত্রাক, যা কেড়ে নিচ্ছে জীবন!

মৃত্যু ঘাতক ছত্রাকের বিরুদ্ধে এক কঠিন লড়াই: বিশ্বজুড়ে বাড়ছে বিপদ, বাংলাদেশও কি ঝুঁকিতে?

বিশ্বজুড়ে ক্রমশ বাড়ছে এমন কিছু ছত্রাকের সংক্রমণ, যা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, এই ছত্রাকগুলো এখন এক নতুন ‘সুপারবাগ’ সংকট তৈরি করছে, যা মোকাবিলা করা আগের চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে।

মানুষের শরীরে এবং পরিবেশে থাকা এই অণুজীবগুলো ফুসফুস, ত্বক, মস্তিষ্কসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, এই মুহূর্তে ১৯টি ছত্রাক প্রজাতি নতুন ওষুধ আবিষ্কারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা টরেন্স ইরভিন-এর কথা ধরা যাক। ২০১৮ সালে তিনি বাড়ির পেছনের উঠোনে বসে ছিলেন, সেই সময় ‘কক্সিডিওডেস’ নামক এক প্রকার ছত্রাকের স্পোর তার ফুসফুসে প্রবেশ করে। প্রথমে বিষয়টি গুরুত্ব দেননি তিনি।

কিন্তু ধীরে ধীরে তার শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। একসময় তিনি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে, চিকিৎসকরাও তার চিকিৎসার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ইরভিনের মতো আরও অনেকে, যেমন রব পার্ডিও এই ধরনের ছত্রাকের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন। এই সংক্রমণ তাদের শরীরে মারাত্মক জটিলতা তৈরি করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাকটেরিয়ার সুপারবাগগুলির কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হলেও, ছত্রাকঘটিত রোগের চিকিৎসায় পর্যাপ্ত ওষুধ নেই। ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে যেখানে কয়েকশ’ অ্যান্টিবায়োটিক রয়েছে, সেখানে ছত্রাক সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় মাত্র ১৭টি ওষুধ।

এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, মানুষের সঙ্গে ছত্রাকের জিনগত মিল অনেক বেশি। তাই এমন ওষুধ তৈরি করা কঠিন, যা ছত্রাককে মেরে ফেলবে, কিন্তু মানুষের কোনো ক্ষতি করবে না।

চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা, যেমন— যারা কেমোথেরাপি নিচ্ছেন, এইডস-এ আক্রান্ত, অথবা অঙ্গ প্রতিস্থাপন করেছেন, তাদের মধ্যে এই ধরনের সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তবে, সুস্থ মানুষেরও আক্রান্ত হওয়ার নজির রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর তালিকায় শীর্ষে থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ ছত্রাক প্রজাতি হলো ‘ক্রিপ্টোকক্কাস নিওফরম্যান্স’। এটি মেনিনজাইটিস-এর মতো মারাত্মক রোগের কারণ হতে পারে।

এই সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুর হার অনেক বেশি, বিশেষ করে এইচআইভি আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে তা প্রায় ৬১ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়াও, ‘অ্যাসপারজিলাস ফুমিগেটাস’ নামক ছত্রাক ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে যেতে পারে।

আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো ‘ক্যান্ডিডা অউরিজ’ নামক ছত্রাক। এটি ইতোমধ্যে অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে ফেলেছে। এই ছত্রাকটি সহজে প্লাস্টিক এবং ত্বকের সাথে লেগে থাকতে পারে, যা হাসপাতাল, নার্সিংহোম এবং ডায়ালাইসিস ক্লিনিকগুলোতে এর বিস্তারকে আরও কঠিন করে তোলে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, দাবানল এবং ধুলোঝড়ের কারণেও এই ছত্রাকগুলির বিস্তার বাড়ছে। ক্যালিফোর্নিয়ার ‘স্যান জোয়াকিন ভ্যালি’ সহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে কক্সিডিওডেস-এর সংক্রমণ বাড়ছে।

বাংলাদেশেও কি এই বিপদ বাড়ছে?

বাংলাদেশের পরিবেশ এবং জলবায়ু ছত্রাক সংক্রমণের জন্য অনুকূল। এখানকার আর্দ্রতা এবং উষ্ণতা ছত্রাকের দ্রুত বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। আমাদের দেশেও ফুসফুস সংক্রমণ, মেনিনজাইটিস এবং ত্বক-সংক্রান্ত ছত্রাকঘটিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।

তাই, অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের অপ্রতুলতা এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়া উদ্বেগের কারণ। জনসচেতনতা বৃদ্ধি, রোগ নির্ণয়ের উন্নত ব্যবস্থা এবং সময় মতো চিকিৎসার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করা গেলে, এই ধরনের সংক্রমণ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এছাড়াও, নতুন ওষুধ আবিষ্কারের জন্য গবেষণা এবং স্বাস্থ্যখাতে আরও বেশি বিনিয়োগ করা প্রয়োজন।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *