মরুভূমির বুকে এক টুকরো সবুজ— মরক্কোর একটি মরূদ্যান, যা আজ অস্তিত্বের সংকটে। জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে সেখানকার জীবনযাত্রা চরম হুমকির মুখে। এই ঘটনা যেন বাংলাদেশের জন্যও এক সতর্কবার্তা।
উত্তর আফ্রিকার দেশ মরক্কোর দক্ষিণ প্রান্তে আটলাস পর্বতমালা থেকে কিছুটা দূরে গেলে, সাহারা মরুভূমির প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত ‘মহামিদ এল ঘিজlane’ নামক একটি মরূদ্যানের দেখা মেলে। একসময় সবুজ আর শ্যামল প্রকৃতির লীলাভূমি ছিল এই স্থান। এখানকার মানুষজন ‘দ্রা’ নদীর স্বচ্ছ জলে মাছ ধরত, আর খেজুর গাছের ছায়ায় পশুচারণ করত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আজ সেই দৃশ্য অতীত। বৃষ্টি কমে যাওয়ায় শুকিয়ে গেছে নদী, আর মরুকরণের ফলে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মরূদ্যানটি।
মহামিদের ৫৬ বছর বয়সী বাসিন্দা হালিম সবাঈ জানান, একসময় তাদের এই এলাকা সবুজ-শ্যামল ছিল, যা এখন শুধুই বালুকাময়। তাঁর কথায়, “যখন জল থাকে না, সবুজ থাকে না, তখন বালি দ্রুত শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং গ্রাস করতে শুরু করে।” প্রতি বছর এই মরূদ্যানটি প্রায় ৩০০ ফুটের বেশি হারে তার সবুজ অঞ্চল হারাচ্ছে। এখানকার বাসিন্দারা ভালো জীবনের আশায় অন্য কোথাও পাড়ি জমাচ্ছে। ফলে, জনশূন্য হয়ে পড়ছে ঘরবাড়ি, যা ধীরে ধীরে বালির নিচে চাপা পড়ছে।
মরুভূমি অঞ্চলে হাজার বছর ধরে মানুষ ওases-এর (মরূদ্যান) ওপর নির্ভর করে জীবন ধারণ করে এসেছে। তারা কঠোর পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য এক জটিল কৃষি ব্যবস্থা তৈরি করেছিল। মরক্কোতে এই ধরনের মরূদ্যানগুলোতে প্রায় দশ লক্ষ মানুষের বসবাস। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেখানকার তাপমাত্রা বাড়ছে, বৃষ্টি কমে যাচ্ছে এবং দেখা দিচ্ছে তীব্র খরা।
ঐতিহ্যগতভাবে, মরূদ্যানের প্রধান উপাদান হলো খেজুর গাছ ও মানুষ। খেজুর গাছ এখানকার পরিবেশের সঙ্গে মানানসই এবং এটি চাষ করার জন্য প্রচুর শ্রম ও প্রকৌশল জ্ঞানের প্রয়োজন। একসময় এখানকার ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার জন্য মারাকেশ থেকে টিনবুকটু যাওয়ার পথে এই মরূদ্যানগুলোতে বিশ্রাম নিত।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে এখানে। সেখানকার তাপমাত্রা বাড়ছে, আর বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এমনকি, ভয়াবহ বন্যায় অনেক পাম গাছও পুড়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে এখানকার কৃষকরা ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার করে তাদের জমি সেচ করেন, যার ফলে মাটির লবণাক্ততা বাড়ছে এবং ফসল উৎপাদন কঠিন হয়ে পড়েছে। সবাঈ মনে করেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে মরূদ্যানটি দ্রুত ধ্বংস হয়ে যাবে।
আরেকজন স্থানীয় কৃষক, ৪৮ বছর বয়সী আবদেল করিম বান্নাউয়ি বলেন, একসময় খরা হলেও পাম গাছগুলো টিকে ছিল। কিন্তু এখন তারাও দুর্বল হয়ে পড়ছে। তিনি মনে করেন, এখানে কৃষিকাজের ভবিষ্যৎ নেই।
স্থানীয় জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ গত ২০ বছরে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। যারা এখনো আছেন, তাঁদের পক্ষে এখানকার পাম গাছ ও সেচের ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তবে, এই পরিস্থিতিতেও হালিম সবাঈ-এর মতো কিছু মানুষ তাঁদের ঐতিহ্য ও পরিবেশ রক্ষার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি সাহারা রুটস নামক একটি ডাচ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে মিলে কাজ করছেন, যেখানে মরূদ্যান রক্ষার জন্য গাছ লাগানো হচ্ছে। এছাড়াও, তাঁরা সেচের জন্য ড্রিপ-ইরিগেশন পদ্ধতি ব্যবহার করছেন, যা পানির ব্যবহার কমায়।
সবাঈ মনে করেন, ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পারলে এবং সমাজের সবাই মিলেমিশে কাজ করলে এই সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব। তিনি স্থানীয় তরুণদের উৎসাহিত করার জন্য ‘যুদুর সাহারা’ নামে একটি সঙ্গীত স্কুল তৈরি করেছেন। এই স্কুলে সাহারার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও সঙ্গীত শেখানো হয়, যা তরুণদের মধ্যে তাঁদের সংস্কৃতি ও পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা বাড়ায়।
মরক্কোর এই মরূদ্যানের সংকট বাংলাদেশের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের দেশেও বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি। তাই, এখনই আমাদের পরিবেশ রক্ষার জন্য সচেতন হতে হবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে টেকসই উন্নয়নের পদক্ষেপ নিতে হবে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক