প্রাচীন রোমে গ্ল্যাডিয়েটর ও সিংহের লড়াইয়ের নতুন প্রমাণ: ইয়র্কের মাটি খুঁড়ে মিলল ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত।
প্রাচীন রোমের অ্যারেনাগুলোতে গ্ল্যাডিয়েটরদের (যোদ্ধা ক্রীতদাস) সঙ্গে বন্য সিংহের লড়াইয়ের দৃশ্য ছিল অত্যন্ত পরিচিত। এই দৃশ্যগুলো মোজাইক ও খোদাই করা ছবিতে দেখা গেলেও, এর কোনো বাস্তব প্রমাণ পাওয়া কঠিন ছিল।
তবে সম্প্রতি, গবেষকরা প্রায় ১,৮০০ বছর আগের একটি কঙ্কালে সিংহের কামড়ের চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন, যা এই ধারণাকে আরও জোরালো করে।
যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক শহরে (প্রাচীন ইয়োরকাম/Eboracum) পাওয়া ওই কঙ্কালটি সম্ভবত একজন গ্ল্যাডিয়েটরের, যিনি সম্ভবত সিংহের সঙ্গে লড়াইয়ে নিহত হয়েছিলেন। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন কিং’স কলেজ লন্ডনের প্রত্নতত্ত্ববিদ জন পিয়ার্স।
তাঁর মতে, এই কঙ্কালটিই রোমান বিশ্বে এমন একজন ব্যক্তির উদাহরণ, যার শরীরে কোনো হিংস্র প্রাণীর কামড়ের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এই আবিষ্কার প্রমাণ করে যে, অ্যারেনাগুলোতে খেলার জন্য সুদূর আফ্রিকা থেকে বন্য পশু আনা হতো।
গবেষকরা আধুনিক সিংহের কামড়ের সঙ্গে কঙ্কালের ক্ষত চিহ্নের তুলনা করেছেন। তারা দেখেছেন, ক্ষতগুলো সম্ভবত মৃত্যুর সময়েই তৈরি হয়েছিল।
এর কারণ, কামড়ের স্থানের হাড়গুলো ভাঙা ছিল এবং সেখানে কোনো আঘাত সারার চিহ্ন ছিল না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মৃত ব্যক্তি গ্ল্যাডিয়েটর ছিলেন নাকি কোনো অপরাধী, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে এই আবিষ্কার প্রাচীন রোমের নিষ্ঠুর খেলাগুলোর একটি চিত্র তুলে ধরে।
ইয়র্কের একটি গ্ল্যাডিয়েটর গোরস্থান?
প্রায় ২০ বছর আগে ইয়র্কের এই কঙ্কালটি আবিষ্কার করা হয়। ইয়র্ক, একসময় ব্রিটানিয়া প্রদেশের (বর্তমান ইংল্যান্ড ও ওয়েলস) একটি গুরুত্বপূর্ণ রোমান শহর ছিল।
কঙ্কালটি সম্ভবত তৃতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি বা শেষের দিকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। যদিও সেখানে কোনো সমাধির পাথর বা চিহ্ন পাওয়া যায়নি, তবে গবেষকদের ধারণা, এটি গ্ল্যাডিয়েটরদের কবরস্থান ছিল।
কারণ, সেখানে পাওয়া অন্যান্য কঙ্কালগুলোর শরীরেও যুদ্ধের চিহ্ন ছিল। অনেকের মাথা কেটে ফেলা হয়েছিল, যা গ্ল্যাডিয়েটরদের মধ্যে আহত হলে সাধারণত করা হতো।
কিছু বিশেষজ্ঞ এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাদের মতে, মৃত ব্যক্তি সম্ভবত একজন *venatore* (বন্য পশুর সঙ্গে যুদ্ধ করা ব্যক্তি) ছিলেন।
অথবা, তিনি হয়তো কোনো অপরাধী ছিলেন, যাকে শাস্তি হিসেবে পশুদের সামনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল ( *damnatio ad bestias*)।
আফ্রিকা থেকে সিংহ : কিভাবে এলো?
প্রশ্ন হলো, আফ্রিকার সিংহ কিভাবে সুদূর ব্রিটেনে এসেছিল? এর উত্তর হলো, একেবারে অসম্ভব নয়।
ইয়র্কে রোমান সাম্রাজ্যের ৬ষ্ঠ সৈন্যদল ছিল, যাদের মধ্যে অনেকে উত্তর আফ্রিকা থেকে এসেছিলেন। প্রত্নতত্ত্ববিদ জন পিয়ার্স জানিয়েছেন, ইয়র্কে পাওয়া কিছু মৃৎপাত্রে উত্তর আফ্রিকার নকশা দেখা যায়।
সম্ভবত, সৈন্যদের সঙ্গে আফ্রিকান কারিগররাও ব্রিটানিয়ায় এসেছিলেন।
এছাড়াও, সে সময়কার সম্রাট সেপ্টিমাস সেভেরাসও এখানে এসেছিলেন।
ধারণা করা হয়, কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য অথবা সৈন্যদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে ইয়র্কে সিংহ পাঠানো হয়েছিল।
তবে সিংহ কেনা সহজ ছিল না। সম্রাট ডায়োক্লেটিয়ানের সময় (A.D. ৩০১) উত্তর আফ্রিকা থেকে একটি সিংহের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ১,৫০,০০০ ডেনারি।
বর্তমান হিসাবে, এটি প্রায় ২৫ থেকে ৫০ কোটি টাকার সমান। এত বেশি দাম দিয়েও, রোমানরা এই ধরনের খেলাধুলাকে খুব গুরুত্ব দিত, কারণ এটি ছিল তাদের বিনোদনের একটি প্রধান মাধ্যম।
এই নতুন আবিষ্কার গ্ল্যাডিয়েটরদের নিয়ে গবেষণা করা প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষকরা আশা করছেন, এই আবিষ্কারের মাধ্যমে ইয়র্কের অ্যাম্পিথিয়েটার (amphitheater) খুঁজে পাওয়া যাবে, যা এখনো মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক