হংকংয়ের এক সময়ের কুখ্যাত স্থান, ‘প্রাচীর ঘেরা কাওলুন শহর’ – যেখানে আইনের শাসন ছিল অনুপস্থিত। এক সময়ের এই জনাকীর্ণ শহরের গল্প, যা আজও কৌতূহল জাগায়।
হংকংয়ের বুকে এক সময় ছিল কাওলুন ওয়ালিড সিটি, যা ছিল এক জটিল ইতিহাসের সাক্ষী। এই শহরের জন্ম হয়েছিল চীনের সাম্রাজ্য শাসনের সময়, যেখানে সামরিক ঘাঁটি ছিল।
পরে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে এটি একটি বিশেষ অঞ্চলে পরিণত হয়। সময়ের সাথে সাথে এই শহরের জনসংখ্যা বাড়তে থাকে, বিশেষ করে চীনের গৃহযুদ্ধের সময় উদ্বাস্তুরা এখানে আশ্রয় নেয়। এক সময় এটি অপরাধের আখড়ায় পরিণত হয়, যেখানে কোনো নিয়ম-কানুন ছিল না।
কাওলুন শহরের উত্থান :
কাওলুন শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৬৬৮ সালে, যখন এটি চীনের একটি সামরিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে, ব্রিটিশরা হংকং দখল করার পর, কাওলুন শহরটিকে তারা চীনের হাতেই ছেড়ে দেয়।
এই কারণে, শহরটিতে ধীরে ধীরে জনবসতি বাড়তে থাকে। এখানে দোকানপাট, স্কুল, কাস্টম হাউস এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তৈরি হতে শুরু করে।
ব্রিটিশ ও চীনের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব :
১৮৯৮ সালে, ব্রিটিশ এবং চীনের মধ্যে হংকংয়ের ভূমি নিয়ে একটি চুক্তি হয়, যার ফলে কাওলুন শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশরা চাইছিল শহরটির উপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে, কিন্তু চীন এতে রাজি ছিল না।
এই কারণে, শহরটিতে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
গৃহযুদ্ধের প্রভাব এবং উদ্বাস্তু আগমন :
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে চীনের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং গৃহযুদ্ধের কারণে বহু মানুষ কাওলুন শহরে আশ্রয় নিতে আসে। শহরের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে, এবং এটি একটি জনাকীর্ণ স্থানে পরিণত হয়।
দরিদ্র ও আশ্রয়হীন মানুষেরা এখানে বসবাস করতে শুরু করে, যাদের কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা ছিল না।
আইনহীন জীবনের চিত্র :
কাওলুন শহর ধীরে ধীরে অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। এখানে কোনো আইন ছিল না, ফলে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ কার্যকলাপ চলত।
বিভিন্ন ধরনের অপরাধ, যেমন – জুয়া খেলা, পতিতাবৃত্তি, এবং মাদক ব্যবসার মতো ঘটনা এখানে নিয়মিত ছিল। শহরের ভবনগুলো ছিল অপরিকল্পিত ও ঘিঞ্জি।
শহরের পতন :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সেনারা বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণের জন্য শহরের দেয়াল ভেঙে দেয়। এরপর ১৯৮০-এর দশকে এখানে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের বসবাস ছিল।
১৯৮৭ সালে ব্রিটিশ সরকার শহরটি ভেঙে ফেলার ঘোষণা দেয়। অবশেষে, ১৯৯৪ সালে বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পর শহরটি ভেঙে দেওয়া হয়।
বর্তমানে সেখানে একটি পার্ক তৈরি করা হয়েছে।
কাওলুন শহরের স্মৃতি :
কাওলুন শহর হয়তো এখন আর নেই, কিন্তু এর গল্প আজও মানুষের মনে কৌতূহল জাগায়। এটি ছিল এক ধরনের স্ব-নিয়ন্ত্রিত এবং স্বতন্ত্র সমাজ, যেখানে মানুষ প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে টিকে থাকার চেষ্টা করেছে।
শহরটি একটি উদাহরণ, যেখানে মানুষ সীমিত সম্পদের মধ্যে তাদের জীবন ধারণের জন্য সংগ্রাম করেছে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক।