ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক শক্তি: উত্তেজনা এবং পারমাণবিক সক্ষমতা।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা নতুন করে বৃদ্ধি পেয়েছে। বুধবার সকালে, ভারত পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যার ফলস্বরূপ অন্তত ২৬ জন নিহত হয়, যাদের মধ্যে তিনজন শিশুও ছিল।
ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে তাদের ‘সিন্দুর অপারেশন’-এর লক্ষ্য ছিল জঙ্গি অবকাঠামো। অন্যদিকে, পাকিস্তানের দাবি, তারা পাঁচটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেছে, যদিও ভারত এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
স্থানীয় কর্মকর্তাদের মতে, বুধবার সকাল থেকে ভারতীয় নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে পাকিস্তানি গোলাবর্ষণে অন্তত ১০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা ভারত উপমহাদেশকে বিভক্ত করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে পরিণত করে। এরপর মানব ইতিহাসের বৃহত্তম এবং সম্ভবত সবচেয়ে রক্তাক্ত অভিবাসন ঘটেছিল।
সেই ঘটনার ৭৮ বছর পরেও, এই দুটি দেশ আজও পরস্পরের প্রতি বৈরী মনোভাবাপন্ন। বর্তমানে উভয় দেশই পারমাণবিক অস্ত্রধর।
জম্মু ও কাশ্মীর, যা একসময় একটি রাজ্য ছিল, ভারত বিভাগের পর থেকেই বিতর্কিত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। ভারত, পাকিস্তান এবং চীন—এই তিনটি দেশই কাশ্মীরের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
ভারত পুরো কাশ্মীরকেই নিজের বলে দাবি করে, যেখানে পাকিস্তানের দাবি হলো ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকা অংশটি তাদের।
এই দুটি দেশ চারটি যুদ্ধ করেছে এবং সীমান্ত পেরিয়ে বহুবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। ২০১৯ সালে, পাকিস্তানের একটি জঙ্গিগোষ্ঠীর আত্মঘাতী হামলায় অন্তত ৪০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর উত্তেজনা আরও বাড়ে।
এর জবাবে ভারত বালাকোটে বিমান হামলা চালায় এবং জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করার দাবি করে। যদিও অনেক বিশ্লেষক ভারতের এই দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
সামরিক শক্তির দিক থেকে দেখলে, গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ারের ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, ভারতের সামরিক শক্তি বিশ্বে চতুর্থ এবং পাকিস্তানের স্থান দ্বাদশ।
সামরিক ব্যয়ের দিক থেকেও ভারত অনেক এগিয়ে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ভারত সামরিক খাতে ৮৬ বিলিয়ন ডলার (বর্তমান বিনিময় হারে প্রায় ৯ লক্ষ কোটি টাকা) খরচ করেছে, যা তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.৩ শতাংশ।
যেখানে পাকিস্তানের সামরিক খরচ ছিল ১০.২ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ১ লক্ষ ৭ হাজার কোটি টাকা), যা তাদের জিডিপির ২.৭ শতাংশ।
সামরিক জনবলের দিক থেকেও ভারতের শক্তি অনেক বেশি। ভারতের সামরিক বাহিনীতে ৫,১৩৭,৫৫০ জন সদস্য রয়েছে, যেখানে পাকিস্তানের রয়েছে ১,৭০৪,০০০ জন।
উভয় দেশেই বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ নেই। ভারতের কাছে ২,২২৯টি সামরিক বিমান এবং ৩,১৫১টি যুদ্ধ ট্যাংক রয়েছে, যেখানে পাকিস্তানের রয়েছে ১,৩৯৯টি বিমান এবং ১,৮৩৯টি ট্যাংক।
নৌবাহিনীর ক্ষেত্রে, পাকিস্তানের নৌবহর আরব সাগরে তাদের ১,০৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলরেখা রক্ষা করে এবং তাদের বহরে রয়েছে ১২১টি নৌযান।
ভারতের উপকূলরেখার দৈর্ঘ্য প্রায় ৬,১০০ কিলোমিটার, যেখানে তাদের নৌযানের সংখ্যা ২৯৩।
নিউক্লিয়ার অস্ত্রের ক্ষেত্রে, ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার ওয়েপনস (ICANW)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পারমাণবিক অস্ত্রের পেছনে বিশ্বে আনুমানিক ৯১.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছে, যার মধ্যে ভারতের খরচ ২.৭ বিলিয়ন ডলার এবং পাকিস্তানের ১ বিলিয়ন ডলার।
ভারত ১৯৭৪ সালে প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালায় এবং ১৯৯৮ সালে আরও পাঁচটি পরীক্ষা করে নিজেদের পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে।
পাকিস্তানেরও একই বছর, অর্থাৎ ১৯৯৮ সালে, পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর মাধ্যমে এই তালিকায় নাম লেখায়।
বর্তমানে, উভয় দেশই ক্ষেপণাস্ত্রের দৌড়ে লিপ্ত, যা তাদের জন্য বিপুল পরিমাণ আর্থিক বোঝা তৈরি করেছে। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (CSIS)-এর মিসাইল ডিফেন্স প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের পারমাণবিক অস্ত্রের মূল লক্ষ্য হলো তাদের প্রতিবেশী পাকিস্তান ও চীন।
ভারত দীর্ঘ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং মোবাইল ভূমি-ভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে। রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে তারা জাহাজ ও সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রও তৈরি করছে।
পাকিস্তানের অস্ত্রাগারে মূলত স্বল্প এবং মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা ভারত পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের কাছ থেকে পাওয়া প্রযুক্তিগত সহায়তা পাকিস্তানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
উভয় দেশের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা অস্ত্র আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে। SIPRI-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারত ২০২০-২০২৪ পর্যন্ত সময়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ ছিল, যা বিশ্ব আমদানির ৮.৩ শতাংশ।
ভারতের অস্ত্রের প্রধান সরবরাহকারী হলো রাশিয়া। তবে তারা ফ্রান্স, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের দিকেও ঝুঁকছে।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের অস্ত্র আমদানিও বেড়েছে। ২০১৫-১৯ সালের তুলনায় ২০২০-২৪ সালে তাদের অস্ত্র আমদানি ৬১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই সময়ে তারা যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছে। বিশ্বব্যাপী অস্ত্র আমদানির তালিকায় পাকিস্তানের অবস্থান পঞ্চম, যা ২০২০-২৪ সালে মোট আমদানির ৪.৬ শতাংশ।
পাকিস্তানের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী হলো চীন। এই সময়ে চীনের কাছ থেকে তারা ৮১ শতাংশ অস্ত্র আমদানি করেছে। একই সময়ে রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের অস্ত্র আমদানির পরিমাণ ছিল ৩৬ শতাংশ।
তথ্যসূত্র: বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা।