ঘূর্ণিঝড়: এক পরিচিত দুর্যোগ, প্রকৃতির বিভীষিকা
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের মানুষের কাছে এক পরিচিত নাম। প্রতি বছরই কোনো না কোনো ঘূর্ণিঝড় আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে, কেড়ে নেয় বহু প্রাণ, আর বয়ে আনে সীমাহীন দুর্ভোগ।
আটলান্টিক মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড়কে “হারিকেন” বলা হলেও, এদের গঠন, শক্তি এবং ধ্বংসের ক্ষমতা প্রায় একই। আসুন, ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে কিছু জরুরি তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
ঘূর্ণিঝড় আসলে কী?
ঘূর্ণিঝড় হলো একটি শক্তিশালী গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়, যা সমুদ্রের উপর সৃষ্টি হয়। এদের কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ ঘন্টায় ৭৪ মাইল (১১৯ কিলোমিটার/ঘন্টা) বা তার বেশি হতে পারে।
আটলান্টিক এবং উত্তর-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে এদের “হারিকেন” বলা হয়। পশ্চিম উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে এদের “টাইফুন” এবং ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে “সাইক্লোন” নামে ডাকা হয়।
ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম কীভাবে?
ঘূর্ণিঝড় তৈরির চারটি প্রধান ধাপ রয়েছে: গ্রীষ্মমন্ডলীয় গোলযোগ, গ্রীষ্মমন্ডলীয় নিম্নচাপ, গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড় এবং ঘূর্ণিঝড়। প্রথমে, উষ্ণ সমুদ্রের উপর মেঘের স্তূপ তৈরি হয়, যা গ্রীষ্মমন্ডলীয় গোলযোগের সৃষ্টি করে।
এরপর এই মেঘগুলি ঘনীভূত হয়ে একটি নিম্নচাপ অঞ্চলের সৃষ্টি করে, যেখানে বাতাসের বেগ বাড়ে। বাতাসের গতিবেগ যখন ৩৯ থেকে ৭৩ মাইল/ঘণ্টা (৬৩ থেকে ১১৭ কিলোমিটার/ঘন্টা) এর মধ্যে পৌঁছায়, তখন তাকে গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড় বলা হয় এবং এর নামকরণ করা হয়।
সবশেষে, বাতাসের গতিবেগ যখন ৭৪ মাইল/ঘণ্টা (১১৯ কিলোমিটার/ঘন্টা) অতিক্রম করে, তখন সেটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়।
ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি কীভাবে মাপা হয়?
ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি পরিমাপের জন্য “সাফির-সিম্পসন হারিকেন উইন্ড স্কেল” ব্যবহার করা হয়। এই স্কেলে ঘূর্ণিঝড়কে ১ থেকে ৫ ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়, যা বাতাসের গতি এবং এর কারণে সৃষ্ট ক্ষতির পরিমাণ নির্দেশ করে।
* **ক্যাটাগরি ১:** বাতাসের বেগ ৭৪-৯৫ মাইল/ঘণ্টা (১১৯-১৫৩ কিলোমিটার/ঘণ্টা)। সামান্য ক্ষতি হতে পারে।
* **ক্যাটাগরি ২:** বাতাসের বেগ ৯৬-১১০ মাইল/ঘণ্টা (১৫৪-১৭৭ কিলোমিটার/ঘণ্টা)। কিছু ভবনের ক্ষতি হতে পারে।
* **ক্যাটাগরি ৩:** বাতাসের বেগ ১১১-১৩০ মাইল/ঘণ্টা (১৭৮-২০৯ কিলোমিটার/ঘণ্টা)। ছোট আকারের ভবনের কিছু ক্ষতি হতে পারে।
* **ক্যাটাগরি ৪:** বাতাসের বেগ ১৩১-১৫৫ মাইল/ঘণ্টা (২১০-২৪৯ কিলোমিটার/ঘণ্টা)। ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
* **ক্যাটাগরি ৫:** বাতাসের বেগ ১৫৫ মাইলের বেশি (২৪৯ কিলোমিটার/ঘণ্টা)। এই ক্যাটাগরির ঘূর্ণিঝড় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারে।
ঝড়ের তাণ্ডব: জলোচ্ছ্বাস ও ক্ষয়ক্ষতির চিত্র
ঘূর্ণিঝড়ের সময় সবচেয়ে ভয়ংকর একটি দিক হলো জলোচ্ছ্বাস। শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় সমুদ্রের জলকে উপরে তুলে বিশাল ঢেউ তৈরি করে, যা উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে।
এই জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতার উপর নির্ভর করে। ক্যাটাগরি ১-এর ঘূর্ণিঝড়ে ৩-৫ ফুট (১-১.৫ মিটার) পর্যন্ত জলোচ্ছ্বাস হতে পারে, যেখানে ক্যাটাগরি ৫-এর ঘূর্ণিঝড়ে ১৮ ফুটের বেশি (প্রায় ৫.৫ মিটারের বেশি) জলোচ্ছ্বাস হতে পারে, যা উপকূলের অনেক এলাকা প্লাবিত করে দেয়।
ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ: নামকরণের তাৎপর্য
ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের একটি বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। আটলান্টিক মহাসাগরের ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের জন্য নারী ও পুরুষের নামের তালিকা ব্যবহার করা হয়।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (World Meteorological Organization – WMO) এই নামের তালিকা তৈরি করে, যা প্রতি ৬ বছর পর পর পুনর্ব্যবহৃত হয়। তবে, যে ঘূর্ণিঝড়গুলো ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে, তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
যেমন, ২০০৫ সালের “ক্যাটরিনা”, ২০১২ সালের “স্যান্ডি”, ২০১৭ সালের “মারিয়া” এবং ২০২২ সালের “ইয়ান”-এর মতো ঘূর্ণিঝড়ের নাম তালিকা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তুতি ও সতর্কতা: ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবিলায় করণীয়
যেহেতু বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়প্রবণ একটি দেশ, তাই আমাদের ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে এবং দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
ঘূর্ণিঝড়ের সময় বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (Bangladesh Meteorological Department – BMD) থেকে প্রচারিত সতর্কতাগুলো মেনে চলা উচিত। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া, প্রয়োজনীয় শুকনো খাবার ও পানীয় মজুত করা, এবং কর্তৃপক্ষের সাহায্য চেয়ে জীবন বাঁচানো সম্ভব।
তথ্য সূত্র: সিএনএন