বনমানুষের ড্রামিং: সঙ্গীতের রহস্য!

শিরোনাম: শিম্পাঞ্জিদের ছন্দ: সঙ্গীত এবং ভাষার উৎপত্তির সন্ধানে নতুন দিগন্ত

বন্য পরিবেশে শিম্পাঞ্জিরা গাছের গুঁড়িতে তালে তালে আঘাত করে শব্দ তৈরি করে, যা তাদের যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন যে, শিম্পাঞ্জিরা শুধু শব্দ তৈরিই করে না, বরং তাদের নিজস্ব শৈলীও রয়েছে।

আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে এই ধরনের ভিন্নতা দেখা যায়, যা মানুষের ভাষার মতোই সাংস্কৃতিক পার্থক্যের ইঙ্গিত দেয়।

ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কগনিটিভ বায়োলজিস্ট ভেস্তা এলিউতেরি এবং সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাইমেটোলজিস্ট ক্যাথরিন হোবাইটারের নেতৃত্বে গবেষকরা পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে প্রায় সাড়ে তিনশো বারের বেশি শিম্পাঞ্জিদের এই ধরনের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারা দেখেছেন, শিম্পাঞ্জিরা গাছের শিকড়ে আঘাত করে এক ধরনের ছন্দ তৈরি করে, যা অনেক দূর পর্যন্ত শোনা যায়।

কোনো কোনো সময় তাদের হাত ও পায়ের দ্রুত নাড়াচাড়ায় যেন সব কিছু ঝাপসা হয়ে যায়। গবেষকদের মতে, এই ছন্দবদ্ধতা তাদের দলের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের একটি উপায়।

শুধু তাই নয়, শিম্পাঞ্জিরা তাদের কণ্ঠস্বরের মাধ্যমেও জটিল বার্তা আদান-প্রদান করতে পারে। তারা বিভিন্ন ধরনের শব্দ তৈরি করে, যা নির্দিষ্ট ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত।

উদাহরণস্বরূপ, খাবার খাওয়ার সময় তারা এক ধরনের শব্দ করে, আবার সামাজিক মেলামেশার সময় ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করে। এমনকি, দুটি শব্দের মিশ্রণে তারা নতুন অর্থ তৈরি করতে পারে, যা ভাষার বিবর্তনের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

ফ্রান্সের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সাইন্টিফিক রিসার্চের (CNRS) বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী সেড্রিক গিরার্ড-বুত্তোজের মতে, শিম্পাঞ্জিদের এই জটিল যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাষার মতোই অনেক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।

এই গবেষণাগুলো থেকে ধারণা করা হচ্ছে, মানুষের সঙ্গীত এবং ভাষার উৎপত্তির পেছনে শিম্পাঞ্জিদের এই আচরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হতে পারে। গবেষকরা মনে করেন, প্রায় ৫ থেকে ৭ মিলিয়ন বছর আগে শিম্পাঞ্জি, বনমানুষ এবং মানুষের মধ্যে একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল, যাদের মধ্যে এই ধরনের যোগাযোগের প্রবণতা বিদ্যমান ছিল।

অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিদ প্রিতি প্যাটেল-গ্রোস মনে করেন, শিম্পাঞ্জিদের কণ্ঠস্বর এবং ছন্দবদ্ধ শব্দ তৈরি—উভয়ই হয়তো একসঙ্গে বিকশিত হয়েছে এবং এর মাধ্যমে ভাষা ও সঙ্গীতের বিবর্তন সম্পর্কে নতুন ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

গবেষকরা আরও দেখেছেন, পূর্ব এবং পশ্চিম আফ্রিকার শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে বাদ্যযন্ত্রের ধরনেও পার্থক্য রয়েছে। পশ্চিমা শিম্পাঞ্জিরা সাধারণত দ্রুত এবং ঘন ঘন শব্দ তৈরি করে, যেখানে পূর্বাঞ্চলের শিম্পাঞ্জিরা ধীরে শব্দ করে।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই পার্থক্য তাদের সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত। পশ্চিমা শিম্পাঞ্জিরা সাধারণত বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সমতাবাদী, যেখানে পূর্বাঞ্চলের শিম্পাঞ্জিরা একটু বেশি আগ্রাসী এবংhierarchical হয়।

সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাথরিন হোবাইটার বলেন, যেহেতু ছন্দ মানুষের সামাজিক জীবন, নৃত্য এবং ভাষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তাই আমাদের সামাজিক আচরণও হয়তো ছন্দের বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত।

এই গবেষণাগুলো শিম্পাঞ্জিদের সংরক্ষণের গুরুত্বের ওপর জোর দেয়। কারণ, প্রতিটি শিম্পাঞ্জি দলের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, যা তাদের যোগাযোগের ধরন, বাদ্যযন্ত্রের শৈলী এবং সামাজিক আচরণে প্রতিফলিত হয়।

একটি দল বিলুপ্ত হয়ে গেলে, তার সঙ্গে সেই অঞ্চলের সংস্কৃতিও হারিয়ে যায়।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *