আশ্চর্য! হেগে বন্দী, তবুও নিজ শহরে মেয়র হওয়ার পথে!

ফিলিপাইনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতের্তে বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)-এ বিচারের সম্মুখীন। তবে, এই বিতর্কের মধ্যেই তিনি তার নিজ শহর দাভাও-এর মেয়র পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আগামী নির্বাচনে তার জয়ের সম্ভাবনাও বেশ উজ্জ্বল।

দাভাও শহরে এখন নির্বাচনী প্রচারণা তুঙ্গে। মেয়র পদের প্রার্থীরা ভোটারদের সমর্থন আদায়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে একজন, রদ্রিগো দুতের্তে, প্রচারে সরাসরি অংশ নিতে পারছেন না। কারণ তিনি বর্তমানে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের জন্য অপেক্ষমান।

দুতের্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন মাদকবিরোধী অভিযানের নামে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছেন, যার মধ্যে অনেক নিরীহ মানুষও ছিলেন। এই অভিযোগের ভিত্তিতেই তার বিচার চলছে। যদিও এমন গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, তবুও ফিলিপাইনের নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, স্থানীয় আদালতে দোষী সাব্যস্ত না হলে একজন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। তাই দুতের্তের মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোনো বাধা নেই।

দুতের্তের জনপ্রিয়তা এখনো দাভাও অঞ্চলে বেশ জোরালো। এখানকার অনেক মানুষ মনে করেন, দুতের্তের দুই দশকের শাসনামলে শহরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক উন্নত হয়েছিল। ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি মাদক নির্মূলের নামে দেশজুড়ে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

দাভাও-এর ৪৬ বছর বয়সী বাসিন্দা ইয়ান বালদোজা বলেন, “আমি সারাজীবন এখানে বড় হয়েছি। একসময় এখানে খুন, মারামারি লেগেই থাকত। কিন্তু যখন থেকে দুতের্তে ক্ষমতায় এলেন, তখন পরিস্থিতি বদলে যায়।” তিনি আরও যোগ করেন, “আমি দেখেছি, যারা মারা গেছে, তারা হয় মাদকাসক্ত ছিল, না হয় মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল।” বালদোজা মনে করেন, দুতের্তের সময়ে শহরের নিরাপত্তা বেড়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং জরিপ সংস্থা ডব্লিউআর নিউমারোর প্রধান ক্ল্যাভ আরগুয়েলস জানিয়েছেন, “দুতের্তের গ্রেফতার সেখানকার ভোটারদের উপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি। বরং, তার প্রতি তাদের সমর্থন আরও বেড়েছে।

দুতের্তের মেয়ে সারা দুতের্তে, যিনি বর্তমানে ফিলিপাইনের ভাইস প্রেসিডেন্ট, এক নির্বাচনী সমাবেশে তার বাবার পক্ষে সমর্থকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “রাষ্ট্রপতি রদ্রিগো দুতের্তে আপনাদের ভালোবাসা, সমর্থন ও প্রার্থনার জন্য কৃতজ্ঞ। তিনি চান, একদিন তিনি দেশে ফিরতে পারবেন।

উল্লেখ্য, ফিলিপাইনে আসন্ন নির্বাচনে কাউন্সিলর থেকে শুরু করে মেয়র এবং আইনপ্রণেতা পর্যন্ত বিভিন্ন পদের জন্য ভোট গ্রহণ করা হবে। দুতের্তের পরিবারের সদস্যরাও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বর্তমান মেয়র সেবাস্তিয়ান দুতের্তে, যিনি রদ্রিগো দুতের্তের ছেলে, তার বাবার রানিংমেট হিসেবে নির্বাচনে লড়ছেন। অন্যদিকে, দুতের্তের আরেক ছেলে পাওলোও জাতীয় কংগ্রেসে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। পাওলোর দুই ছেলেও স্থানীয় কাউন্সিলর পদের জন্য নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন।

তবে, দুতের্তের জনপ্রিয়তা অটুট থাকলেও তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। বয়স্ক হওয়ার কারণে এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে তার উত্তরসূরি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং আটেনো দে দাভাও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক রামন বেলেনো বলেন, “দাভাও-এর মানুষের ধারণা, একটি রাজনৈতিক পরিবার ভালো কাজ করলে তাদের সমর্থন করা যায়। তবে, সেই পরিবারের প্রধান যদি দুর্বল হয়ে পড়েন, তাহলে সমস্যা হতে পারে।

দুতের্তের অনুপস্থিতিতে দাভাও শহরে বিরোধী দলগুলোও ধীরে ধীরে সক্রিয় হচ্ছে। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রয়াত জাতীয় স্পিকার প্রসপেরো নোগালেসের বংশধররা, যারা দুতের্তের পরিবারের সঙ্গে পুরনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত। কার্লো নোগালেস মেয়র পদের জন্য রদ্রিগো দুতের্তের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অন্যদিকে, কার্লোর বোন মার্গারিটা পাওলোর বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়ছেন।

অন্যদিকে, দুতের্তে পরিবারের মধ্যে বিভেদও দেখা যাচ্ছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট সারা দুতের্তের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়রের দীর্ঘদিনের বিরোধ চলছে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে।

যদি দুতের্তে নির্বাচনে জয়লাভ করেন, তাহলে তিনি হয়তো অনুপস্থিত থেকেও মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে তিনি সম্ভবত ভার্চুয়ালি শপথ নিতে পারেন, যদি আইসিসি অনুমতি দেয়। আরগুয়েলসের মতে, যদি দুতের্তেকে ভার্চুয়ালি শপথ নেওয়ার অনুমতি না দেওয়া হয়, তাহলে নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে থাকা প্রার্থী (সম্ভাব্যত কার্লো নোগালেস) মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।

রদ্রিগো দুতের্তে ফিলিপাইনে ছয় বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। তার বিতর্কিত মাদকবিরোধী অভিযানে পুলিশের গুলিতে এবং অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের হাতে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এই সংখ্যা ৬ হাজার। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, মৃতের সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি।

দুতের্তের এই কঠোর নীতির কারণে বিরোধী আইনপ্রণেতারা তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছিলেন। জবাবে দুতের্তে তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কারারুদ্ধ করেন এবং কিছু সংবাদমাধ্যম ও অধিকারকর্মীকে বিশ্বাসঘাতক ও ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেন।

আইসিসি-তে দুতের্তের পরবর্তী শুনানির তারিখ ২৩শে সেপ্টেম্বর ধার্য করা হয়েছে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *