বন্দীদের ভাগ্য নাকি যুদ্ধ? নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্তে ইসরায়েলে ফাটল!

গাজায় জিম্মিদের ভাগ্য এবং নেতানিয়াহুর ‘চিরস্থায়ী যুদ্ধ’ নিয়ে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বিভেদ বাড়ছে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর গাজা যুদ্ধ পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে ইসরায়েলের ভেতরে বিভেদ বাড়ছে। একদিকে হামাসের হাতে বন্দী ইসরায়েলিদের মুক্তি, নাকি গাজায় হামাসকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করা—এই দুইয়ের মধ্যে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে গিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে ইসরায়েলি সমাজ। সমালোচকরা বলছেন, নেতানিয়াহু যেন একটি ‘চিরস্থায়ী যুদ্ধ’ চালিয়ে যাচ্ছেন।

গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকেই নেতানিয়াহুর সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা বাড়ছে। প্রথমে, হামলার প্রতিরোধ করতে না পারায় এবং পরে, ১৯ মাস ধরে চলা যুদ্ধ বন্ধ করতে না পারায় তিনি সমালোচিত হচ্ছেন। এছাড়া, গাজার ‘পরবর্তী দিন’ কেমন হবে, সে বিষয়েও তার কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই।

মার্চ মাসে, নেতানিয়াহু একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেন, যা জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার একটি চুক্তির সুযোগ তৈরি করতে পারতো। এই সিদ্ধান্তের ফলে ইসরায়েলি সমাজে বিভেদ আরও বাড়ে, কারণ অনেকেই মনে করেন, এর ফলে গাজা থেকে জিম্মিদের জীবিত ফিরে আসার সম্ভাবনা কমে গেছে।

সম্প্রতি, বিভিন্ন সামরিক ইউনিটের সদস্যরা সরকারের নীতির প্রতিবাদে খোলা চিঠি লিখেছেন। এই অসন্তোষ জনগণের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। চলতি মাসের শুরুতে, হাজার হাজার ইসরায়েলি তেল আবিবের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামনে জড়ো হয়ে নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন। নেতানিয়াহু গাজায় আরও ৬০ হাজার রিজার্ভ সেনা মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যেখানে ইসরায়েলি বাহিনী ইতোমধ্যে ৫০,০০০ এর বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি।

এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে, ইসরায়েলের একটি বিশেষ বাহিনী, বিমানবাহিনীর বর্তমান ও প্রাক্তন সদস্যরা একটি চিঠি প্রকাশ করে অভিযোগ করেন, এই যুদ্ধ নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য, নিরাপত্তা রক্ষার জন্য নয়। বিমানবাহিনীর অনুকরণে নৌবাহিনী, সামরিক বাহিনীর বিশেষ ইউনিট এবং মোসাদের সদস্যরাও একই ধরনের প্রতিবাদ জানান।

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধকে ব্যক্তিগত ফায়দার জন্য ব্যবহারের অভিযোগ আগেও উঠেছে। সমালোচকদের মতে, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে নেতানিয়াহু তার বিরুদ্ধে আসা বিভিন্ন অভিযোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন। তার বিরুদ্ধে ২০১৯ সাল থেকে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এবং ৭ অক্টোবরের আগে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে তদন্তের দাবিও উঠেছে।

এছাড়াও, নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তার অফিসের সদস্যরা কাতার থেকে অর্থ নিচ্ছেন। যদিও কাতার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং একে ‘মিথ্যা প্রচারণা’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। কাতার মধ্যস্থতা করে সংঘাত বন্ধের চেষ্টা করছিল।

যুদ্ধ অব্যাহত থাকার কারণে নেতানিয়াহু এসব বিষয় থেকে মনোযোগ ঘোরাতে পারছেন এবং চরম ডানপন্থী দলগুলোর সঙ্গে জোট ধরে রাখতে পারছেন। এই দলগুলো স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, গাজায় সম্পূর্ণ বিজয় ছাড়া যুদ্ধের সমাপ্তি হলে তারা সরকার থেকে বেরিয়ে আসবে, যা সম্ভবত নেতানিয়াহুর পতনের কারণ হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজায় নেতানিয়াহুর নতুন করে সেনা পাঠানোর ঘোষণার ফলে হয়তো সংঘাতের সমাপ্তি ঘটবে না, বরং ইসরায়েল একটি ‘চিরস্থায়ী যুদ্ধে’ জড়িয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সংস্থা ‘গ্লোবাল গার্ডিয়ান’-এর প্রাক্তন মার্কিন বিশেষ বাহিনীর কমান্ডার কর্নেল সেথ ক্রুমরিচ আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘গাজা কেবল লোকজনকে শুষে নেবে। এমনকি উত্তর ইসরায়েল রক্ষা, ইরানের মোকাবিলা করা বা ইসরায়েলের রাস্তা রক্ষার বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে।’ তিনি রিজার্ভ সেনাদের ঘাটতির বিষয়েও সতর্ক করেন।

ইসরায়েলি গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, অনেক রিজার্ভ সেনা আর কাজে যোগ দিচ্ছেন না। এদের অধিকাংশই হলেন ‘নিরপেক্ষ’ রিজার্ভ সেনা, যারা গাজায় ব্যাপক হত্যার বিষয়ে কোনো আদর্শগত আপত্তি না জানালেও, বারবার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।

সংগঠন ‘নিউ প্রোফাইল’-এর একজন মুখপাত্র জানান, রিজার্ভ সেনাদের মধ্যে দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতির সংখ্যা বাড়ছে। তবে, ইসরায়েলি সরকারের নীতিতে পরিবর্তনের কারণে এই সংখ্যা বাড়ছে। যেমন, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘিত হলে অথবা কর্মকর্তাদের বক্তব্যে যখন মনে হয় জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা বা হামাসকে ধ্বংস করা নয়, বরং গাজা দখল করাই প্রধান লক্ষ্য, তখন এই সংখ্যা বাড়ে।

সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে অব্যাহতি পাওয়া একটি বিষয় হলো, অতি-গোঁড়া হারেদি সম্প্রদায়ের সদস্যরা। গত বছর সুপ্রিম কোর্ট তাদের সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে। এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্ট নেতানিয়াহুর কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিল, কেন এই রায় পুরোপুরি কার্যকর করা হয়নি। কারণ, নেতানিয়াহু তার জোট টিকিয়ে রাখতে হারেদি সম্প্রদায়ের সমর্থন এর উপর নির্ভরশীল।

যুদ্ধ জুড়ে, জিম্মিদের পরিবারের সদস্যরা এবং তাদের সমর্থকরা নেতানিয়াহুর পদক্ষেপের বিরোধিতা করলেও, চরম ডানপন্থীরা তাকে সমর্থন জুগিয়েছে। তাদের অনেকেই ফিলিস্তিনিদের ভূমি ও বসতবাড়ির উপর বাইবেলের অধিকারের দাবি করেন।

নেতানিয়াহু ঘোষিত ‘পূর্ণ বিজয়ের’ সঙ্গে জিম্মিদের কল্যাণের মধ্যে যে বিরোধ দেখা যাচ্ছে, তা সংঘাতের মতোই দীর্ঘ। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী চরম জাতীয়তাবাদী উপাদানগুলোর সমর্থন লাভ করে নিজের অবস্থান আরও সুসংহত করছেন।

এই নীতি নিয়ে নেতানিয়াহু রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন, যার মধ্যে তার প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টও রয়েছেন। যদিও গ্যালান্ট এই যুদ্ধের বিরোধী ছিলেন না, তবে জিম্মিদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধে জড়িয়ে পড়েন।

অগ্রাধিকারের এই ভিন্নতার কারণে সরকার ও জিম্মিদের পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। নেতানিয়াহু সাধারণত গাজায় বন্দী স্বজনদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে এড়িয়ে চলেন, আর চরম ডানপন্থী রাজনীতিবিদরা সংসদে তাদের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হন।

চ্যাথাম হাউসের অধ্যাপক ইয়োসি মেকেলবার্গ আল জাজিরাকে বলেন, ইসরায়েলি সমাজে বিভেদ নতুন নয়, তবে যুদ্ধ ও সংঘাত তা আরও গভীর করে তোলে। তিনি আরও যোগ করেন, ‘এখন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে কিছু লোক সেনাবাহিনীতে প্রায় ৪০০ দিন কাজ করেছে, আবার কেউ কেউ কোনো দায়িত্ব পালন করতে চাইছে না এবং জোটের মধ্যে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করছে।’

মেকেলবার্গ আরও বলেন, ‘অন্যদিকে, চরম ডানপন্থী মন্ত্রীরা সামরিক লাভের জন্য জিম্মিদের ‘বলিদান’ দেওয়ার কথা বলছেন। অনেকে মনে করেন, এটি দেশের মৌলিক নীতি এবং ইহুদি ধর্মের পরিপন্থী।’

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *