ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা প্রত্যাবর্তনের পর, ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রভাব বিস্তারের পথগুলো যেন নতুন করে উন্মোচিত হয়েছে। বিশেষ করে যারা অর্থ খরচ করতে প্রস্তুত, তাদের জন্য দরজাগুলো আরও বেশি উন্মুক্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এই প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে, যারা তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য করছেন, তাদের জন্য হোয়াইট হাউসের দরজা খোলা হয়েছে। এমনকি তার পরিবারের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসাগুলোও প্রেসিডেন্ট এবং তার ঘনিষ্ঠ মহলের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ তৈরি করেছে। এতে করে স্বার্থের সংঘাতের সম্ভাবনাও বাড়ছে।
ওয়াশিংটনে এরই মধ্যে এমন কিছু নতুন দল তৈরি হয়েছে, যারা ট্রাম্পের সমর্থক ধনী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ স্থান তৈরি করছে, যেখানে তারা অবাধে মিশতে এবং ক্ষমতা প্রদর্শনে সুযোগ পাচ্ছে। ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত লবিং সংস্থাগুলোরও রমরমা অবস্থা।
ওয়াশিংটন ডিসি, যা একসময় ট্রাম্প এবং তার মিত্রদের থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিল, সেই শহরের সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন এসেছে। এখন ক্ষমতা এবং প্রভাব বিস্তারের চিরাচরিত পথগুলো যেন নতুন করে সাজানো হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং শহরের রাজনৈতিক ও সামাজিক অভিজাতদের মধ্যে তার নেটওয়ার্ক আরও গভীর হচ্ছে।
এর একটি বড় উদাহরণ হলো কেনেডি সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্টস। এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি এখন ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণে।
এখানে সাধারণত রিপাবলিকানদের প্রতিবাদের দৃশ্য দেখা যেত। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। সূত্রের খবর অনুযায়ী, কেনেডি সেন্টারের সংস্কারের জন্য ট্রাম্প কংগ্রেসের কাছে ২৫০ মিলিয়ন ডলার ফেডারেল তহবিল চাইছেন।
আগামী মাসে “লে মিজারেবলস” নাটকের একটি প্রদর্শনীতে ট্রাম্পের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। এই অনুষ্ঠানে যারা ২ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেবেন, তারা ট্রাম্পের পাশের আসনে বসে এই নাটক উপভোগ করতে পারবেন এবং প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও যোগ দিতে পারবেন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, আগে কেনেডি সেন্টারে যেতে অস্বস্তি বোধ করতেন অনেক সরকারি কর্মকর্তা। তাদের মনে হতো, এখানে তাদের স্বাগত জানানো হবে না। তবে পরিস্থিতি বদলানোর চেষ্টা চলছে।
নিয়ম নীতির প্রশ্নগুলোও উঠছে। এপ্রিল মাসে, ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে ফ্লোরিডার ডরালে সৌদি আরবের অর্থায়নে অনুষ্ঠিত ‘এলআইভি গলফ’ ইভেন্টে অংশ নিয়েছিলেন।
এরপর ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি ১.৫ মিলিয়ন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করেন। এই সুপার প্যাকটি (Super PAC) তার নির্বাচনী প্রচারে সহায়তা করেছিল এবং আসন্ন রাজনৈতিক লড়াইয়ের জন্য তহবিল সংগ্রহ করছে। এমনকি, তিনি তার মালিকানাধীন একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি, যা তিনি নিজেই তৈরি করেছেন, সেটির শীর্ষ ২২০ জন হোল্ডারের জন্য একটি বিশেষ ভোজের আয়োজন করতে যাচ্ছেন।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক সংস্থা ‘সিটিজেনস ফর রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড এথিক্স’ এর মুখপাত্র জর্ডান লিবোভিটজ বলেছেন, “আমরা আগে এমনটা দেখিনি। এবার যেন সবকিছু অনেক বেশি প্রকাশ্যে হচ্ছে।”
আট বছর আগের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, ট্রাম্পের সন্তানরা, যারা পারিবারিক ব্যবসা পরিচালনা করেন, তারা এখন আর বিদেশি ব্যবসার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন না।
তারা সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতে একটি ট্রাম্প-ব্রান্ডের বিলাসবহুল হোটেল এবং কাতারে একটি গলফ-কেন্দ্রিক উন্নয়ন প্রকল্পের ঘোষণা করেছেন। লিবোভিটজ আরও বলেন, ট্রাম্প সম্ভবত এমন একটি কংগ্রেসের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন না, যারা স্বার্থের সম্ভাব্য সংঘাত নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী নয়।
আর্থিক লেনদেনের পরিমাণও আগের চেয়ে অনেক বেশি। আগে যেখানে তিনি সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা এবং লাইসেন্সিং চুক্তির ওপর নির্ভর করতেন, সেখানে এখন তিনি লাভজনক আর্থিক খাতের দিকে ঝুঁকছেন।
লিবোভিটজ বলেন, “আগে হয়তো তার হোটেলে একটি রুম বুক করলে তিনি সামান্য কিছু পেতেন, কিন্তু এখন তিনি কোটি কোটি ডলার পেতে পারেন।”
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র আনা কেলি অবশ্য এসব উদ্বেগকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সম্পদ তার সন্তানদের দ্বারা পরিচালিত একটি ট্রাস্টের অধীনে রয়েছে। এখানে কোনো স্বার্থের সংঘাত নেই।”
তবে ট্রাম্পের দাবি, তিনি কোনো কিছু থেকে লাভবান হচ্ছেন না। কিন্তু পরে তিনি স্বীকার করেন, “যদি আমার কোনো শেয়ার থাকে এবং আমি ভালো কাজ করি, তাহলে শেয়ার বাজার বাড়লে আমি লাভবান হব।”
এই পরিবর্তনের দিকে এখন ব্যবসায়িক নেতা এবং বিদেশি সরকারগুলোরও নজর রয়েছে। আবুধাবি-ভিত্তিক একটি বিনিয়োগ সংস্থা সম্প্রতি ট্রাম্পের ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ করেছে, যা ট্রাম্প পরিবারের জন্য লাভজনক হতে পারে।
ফ্রেইট টেকনোলজিস নামের একটি সরবরাহ শৃঙ্খল কোম্পানিও ট্রাম্পের ক্রিপ্টো কয়েন কেনার ঘোষণা দিয়েছে।
এসবের বাইরে, আমেরিকান গ্রোথ পার্টনারশিপ নামে নতুন একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, যারা হোয়াইট হাউসের নীতি সম্পর্কে বিশেষ ধারণা এবং প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
এই গোষ্ঠীর সদস্যপদ পেতে ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ডলার পর্যন্ত খরচ হয়।
লবিস্ট ব্রায়ান ব্যালার্ড এবং জেফ মিলার, যারা ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের সহযোগী ও তহবিল সংগ্রাহক, তাদের ক্লায়েন্টের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ব্যালার্ড পার্টনার্স ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে ১৩.৯ মিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে অনেক বেশি।
মিলার স্ট্র্যাটেজিস একই সময়ে ৮.৭ মিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছে। তাদের ক্লায়েন্টরা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগের সুযোগ পান।
হার্ভার্ড, কর্নেল, নর্থওয়েস্টার্ন-এর মতো নামকরা কলেজ, পাবলিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস, এবং বিভিন্ন প্রভাবশালী ল ফার্ম এই লবিস্টদের পরিষেবা নিচ্ছে। ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানিও সম্প্রতি ব্যালার্ড পার্টনার্সকে নিয়োগ করেছে।
এছাড়াও, ট্রাম্পের ধনী সমর্থকরা এখন ‘এক্সিকিউটিভ ব্রাঞ্চ’ নামের একটি ক্লাবে একত্রিত হচ্ছেন, যেখানে তারা সাংবাদিক, লবিস্ট বা বিক্ষোভকারীদের নজরদারি ছাড়াই মিলিত হতে পারেন।
তথ্য সূত্র: সিএনএন