ছোট্ট শিশুর আকাশে ওড়ার মতো প্রশ্ন: বেহেশতে কি শুধু মাংস পাওয়া যায়?

গাজায় খাদ্য সংকট: শিশুদের চোখে দুর্ভিক্ষের বিভীষিকা

মার্চ মাসের শুরুতে গাজায় প্রবেশপথগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পর সেখানকার মানুষজন যে কঠিন পরিস্থিতির শিকার হয়েছে, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকটের খবর প্রায়ই শোনা যায়, কিন্তু গাজার পরিস্থিতি যেন সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

সেখানকার বাসিন্দারা, বিশেষ করে শিশুরা, এই দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে বড় শিকার।

আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, গাজার মানুষজন ভেবেছিল, হয়তো দু’সপ্তাহের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। পবিত্র রমজান মাসে তাঁরা স্বাভাবিকভাবে পরিবারের সঙ্গে ইফতার করতে পারবে।

কিন্তু তাদের সেই আশা পূরণ হয়নি। বরং তারা ক্যানবন্দী খাবার খেয়েই রোজা ভেঙেছে। বাজারে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেখানকার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়।

জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁয়েছিল। এক কেজি সবজির দাম আট ডলারের বেশি, চিনি ২২ ডলার এবং শিশুদের দুধ ১১ ডলারে বিক্রি হচ্ছিল।

এক বস্তা আটার দাম যেখানে আট ডলার ছিল, সেটি দুই মাসের মধ্যে বেড়ে ৩০০ ডলারে পৌঁছে যায়।

গাজার বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে এই দাম দিয়ে খাবার কেনা সম্ভব ছিল না। ফলে, অনেক পরিবার, তাদের মধ্যে লেখকও ছিলেন, দিনের খাবারের সংখ্যা কমিয়ে দেয়।

সকাল ও রাতের খাবার—এই দুই বেলাতেই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হতো। প্রত্যেক সদস্যের খাবারের পরিমাণও কমিয়ে দেওয়া হয়।

রুটি ছিল প্রধান খাদ্য, যা সকলে ভাগ করে খেত। খাবার সংগ্রহের জন্য নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ এবং শিশুদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেকারি ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সামনে অপেক্ষা করতে দেখা যেত।

অনেকের কাছে দিনের একমাত্র খাবার ছিল এটি।

গাজার মধ্যাঞ্চলে বসবাস করা মানুষজন তিনটিমাত্র বেকারীর ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু সেখানেও ছিল চরম দুর্ভোগ।

খাবার সংগ্রহের জন্য দীর্ঘ লাইন, ধাক্কাধাক্কি এবং হুড়োহুড়িতে অনেক সময় পথ বন্ধ হয়ে যেত। এমনকি অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটত।

বেকারীর বাইরে সারারাত মানুষ ঘুমাতো, যেন ভোরবেলা সবার আগে রুটি পাওয়া যায়।

কিন্তু তাদের কপালে অনেক সময় কিছুই জুটত না।

ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) ৩১শে মার্চ তাদের বেকারিগুলো বন্ধ করে দেয়, কারণ তাদের কাছে আটা ও ওভেন চালানোর গ্যাস ফুরিয়ে গিয়েছিল।

এরপর শুরু হয় আসল দুর্ভিক্ষ। দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোও খাদ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয় এবং তাদের রান্না বন্ধ হয়ে যায়।

ক্ষুধার্ত মানুষজন তখন ফেসবুকে সাহায্য চেয়ে পোস্ট করতে শুরু করে।

লেখক জানিয়েছেন, তাদের এলাকায় একটি “ভাগ্যবান” প্রতিবেশী ছিল, যেখানে এখনো রান্না চলত। তাদের আট বছর বয়সী নাতনি দানা বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিদিন সেখানে লাইনে দাঁড়াত।

খাবার পেলে সে খুব খুশি হতো, আর না পেলে কান্নাকাটি করত।

রমজান মাসে, আল-মুফতি স্কুলের কাছে আশ্রয় নেওয়া একটি পরিবারের এক শিশু, খাবার সংগ্রহের সময় গরম তরকারিতে পড়ে গুরুতরভাবে ঝলসে যায় এবং পরে মারা যায়।

গাজার এই দুর্ভিক্ষ সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। অপুষ্টি, দুর্বল শরীর, চোখে ঝাপসা দেখা—এসব এখন স্বাভাবিক ঘটনা।

এমনকি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে আগের চেয়ে দ্বিগুণ শক্তি খরচ করতে হয়।

লেখক জানিয়েছেন, তার ১৮ মাস ও দুই বছর বয়সী দুই নাতি-নাতনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল এবং খাদ্য ও ওষুধের অভাবে তাদের সুস্থ হতে এক মাস লেগেছিল।

লেখকের মা চোখের অস্ত্রোপচারের পর দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসেছেন।

পাঁচ বছর বয়সী খালেদ নামের এক শিশু প্রতিদিন তার মাকে বাবার ছবি দেখিয়ে জানতে চায়, তার বাবা কি বেহেশতে মাংস খাচ্ছে?

সে জানতে চায়, কবে সে বাবার সঙ্গে মিলিত হয়ে খাবার খেতে পারবে।

গাজার এই পরিস্থিতি শিশুদের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। শিশুদের অসহায়ত্ব দেখে অনেকেই চোখের জল ধরে রাখতে পারে না।

তাদের ক্ষুধার্ত চোখে দুর্ভিক্ষের বিভীষিকা ফুটে ওঠে।

সেখানে বোমা হামলা, রোগ এবং খাদ্য সংকটের কারণে মানুষগুলো মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

পুরো বিশ্ব যেন এই দৃশ্য দেখেও নীরব রয়েছে।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *