যুদ্ধবিরতি: ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কি আবারও শান্তির আলো?

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর কাশ্মীর সীমান্তে আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা শান্তি ফিরে এসেছে। কয়েক দিন ধরে চলা তীব্র সংঘর্ষের পর উভয় দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে।

উভয় প্রতিবেশী দেশের মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলা সবচেয়ে খারাপ লড়াইয়ের পর এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভারতীয় সামরিক বাহিনী যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের বিষয়ে পাকিস্তানকে একটি ‘হটলাইন বার্তা’ পাঠিয়েছে। যদি এমন ঘটনা আবার ঘটে, তবে ভারত এর জবাব দেবে বলেও জানানো হয়েছে।

শনিবার রাতে দুই পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে। এরপর রবিবার ভারতীয় সামরিক অভিযান বিভাগের (ডিজিএমও) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাজীব ঘাই সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন।

শনিবারের যুদ্ধবিরতি ঘোষণার আগে কয়েক দিন ধরে দুই দেশই সীমান্তে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়, যাতে প্রায় ৭০ জন নিহত হয়েছে।

পরিস্থিতি যখন বড় যুদ্ধের দিকে যাচ্ছিল, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও চাপের ফলে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়।

যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভারতীয় নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সীমান্তের কাছাকাছি শহরগুলোতে ব্ল্যাকআউটের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাজীব ঘাই সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “কখনও কখনও, এমন সমঝোতাগুলো বাস্তবায়িত হতে সময় নেয়।” তিনি আরও যোগ করেন, “গতকাল ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় ছিল এবং এখনো তারা সেই অবস্থাতেই রয়েছে।”

ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান তার কমান্ডারদের সীমান্তের ওপার থেকে যেকোনো ধরনের ‘লঙ্ঘন’ মোকাবেলা করার নির্দেশ দিয়েছেন। জেনারেল ঘাই আরও জানান, শনিবার দুপুরে তার পাকিস্তানি প্রতিপক্ষ তাকে ফোন করে “শত্রুতা বন্ধ করার” প্রস্তাব দেন এবং জরুরি ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতি চান।

পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ভারতের মন্তব্যের তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে রবিবার সকালে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে এবং লঙ্ঘনের জন্য ভারতকে দায়ী করে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শনিবার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন এবং জানান, ওয়াশিংটনের মধ্যস্থতায় এই চুক্তি হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তান “নিরপেক্ষ স্থানে” বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে সম্মত হয়েছে।

ইসলামাবাদ যুদ্ধবিরতি গঠনে সহায়তা করার জন্য ওয়াশিংটনকে ধন্যবাদ জানিয়েছে এবং কাশ্মির নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে।

তবে, নয়াদিল্লি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বা নিরপেক্ষ স্থানে আলোচনার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। ভারত মনে করে, পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের বিরোধ দ্বিপাক্ষিকভাবেই সমাধান করতে হবে এবং তৃতীয় পক্ষের কোনো অংশগ্রহণের প্রয়োজন নেই।

রবিবার, ট্রাম্প উভয় দেশের নেতাদের আগ্রাসন বন্ধ করতে রাজি হওয়ার জন্য প্রশংসা করেন এবং তাদের সঙ্গে বাণিজ্য “উল্লেখযোগ্যভাবে” বাড়ানোর কথা বলেন।

জম্মু ও কাশ্মীর সহ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। উভয় দেশই কাশ্মীরকে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দাবি করে এবং এর জন্য দুবার যুদ্ধও করেছে।

ভারত এই অঞ্চলে জঙ্গিবাদের জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে, যদিও পাকিস্তান কেবল কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন জোগানোর কথা বলে।

সংঘর্ষের কারণে সীমান্তের উভয় দিকের বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বুধবার যখন লড়াই শুরু হয়, তখন অনেকেই তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়।

পাকিস্তানের লাহোর থেকে আল জাজিরার প্রতিবেদক ওসামা বিন জাভেদ জানান, “সীমান্ত এলাকার অনেক মানুষের জন্য এটি ছিল কঠিন রাত।” তিনি আরও বলেন, “যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও ভোর ও সন্ধ্যায় গোলাগুলি চলেছে।”

যদিও মানুষজন সতর্ক রয়েছে, তবে তারা এখনো “ঘরে ফিরছে না, কারণ তারা মনে করে পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি।” লাইন অফ কন্ট্রোলের (এলওসি) কাছাকাছি বেশ কয়েকটি গ্রামে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

তবে, সেখানকার পরিস্থিতি এখন “আনন্দ ও উদযাপনের” দিকে যাচ্ছে, যোগ করেন বিন জাভেদ।

ভারতের অমৃতসর শহরে, শিখদের পবিত্র স্থান গোল্ডেন টেম্পলের কাছাকাছি, রবিবার সকালে মানুষজন রাস্তায় ফিরে আসে। সম্প্রতি দিনের উত্তেজনার পর স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরুর ইঙ্গিতস্বরূপ একটি সাইরেন বাজানো হয়।

অমৃতসরের এক দোকানদার সাতভীর সিং আলুওয়ালিয়া বলেন, “পাহালগামে সন্ত্রাসীদের হামলার পর থেকে আমরা খুব তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে দিচ্ছিলাম এবং একটা অনিশ্চয়তা ছিল। আমি খুশি যে অন্তত উভয় পক্ষের মধ্যে আর রক্তপাত হবে না।”

অন্য একজন স্থানীয় বাসিন্দা কাশ্মীর উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর “শান্তি” ও “আনন্দের” কথা উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, “বাতাসে সেটা অনুভব করা যায়…তবে কিছুটা ভয়ও রয়েছে। অতীতে উভয় দেশের ইতিহাস বিবেচনা করলে, এটা কত দিন স্থায়ী হবে?”

কাশ্মীরিরা “দীর্ঘস্থায়ী শান্তি চায়, যাতে আমরা আমাদের জীবনযাপন করতে পারি, আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে পারি এবং জীবনকে আরও সুন্দর করতে পারি।”

তবে কিছু সীমান্ত এলাকায় এখনো মানুষদের বাড়ি ফিরতে নিষেধ করা হয়েছে। ভারতীয় নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বারামুলা শহরে, কর্তৃপক্ষ বাসিন্দাদের বিস্ফোরিত না হওয়া অস্ত্রের ঝুঁকির কারণে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে।

পাকিস্তানের খুররাতা শহর থেকে পালিয়ে আসা আজম চৌধুরী (৫৫) জানান, “এখানে মানুষজন আমাদের ভালোভাবে আতিথেয়তা দেখাচ্ছে, তবে একটি পাখি যেমন তার নিজের বাসায় শান্তি অনুভব করে, আমরাও আমাদের বাড়িতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, যদিও সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”

ভারতীয় নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরিতে, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, যা পাকিস্তানি ড্রোন হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তার মেরামতের কাজ এখনো চলছে। ভারতের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ কোম্পানি এনএইচপিসি-র একজন কর্মকর্তা জানান, “প্রকল্পের সামান্য ক্ষতি হয়েছে… আমরা উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছি, কারণ সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *